রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক ক্ষতি

ছবি : সংগৃহীত

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার বহুমুখী প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। রাজনীতিতে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করলে অর্থনীতি স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঋণাত্মক সম্পর্ক সর্বজনবিদিত।

গবেষণায় দেখা গেছে, কেনিয়ায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে পূর্বে এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। 

সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেক বেড়েছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা কি না ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৮৮ শতাংশ।

কোভিড-১৯ চলাকালীন ২০১৯-২০ প্রবৃদ্ধির হার কমে ৩.৪৫ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬.৯৪ শতাংশ এবং ৭.১০ শতাংশে।

এত অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরেও সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ডলার সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এই সংকটকে আরও প্রকট করেছে।

বাংলাদেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির হার ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ছিল ৮.৮৫ শতাংশ, যা কি না ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে এসে দাঁড়ায় ৯.৪৯ শতাংশে। বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকট মূল্যস্ফীতির পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। অধিকন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেক বেড়েছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা কি না ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

সড়ক-রেল-নৌ পথে অবরোধ চলাকালীন যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক সময়ের মতো সচল থাকে না। ফলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হয়। পণ্য সরবরাহ চেইনে বাঁধার সৃষ্টি হয়। যার ফলস্বরূপ দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। কারণ হরতাল বা অবরোধের সময় অল্প সংখ্যক পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করলেও তাদের স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন খরচ দিতে হয়।

ছোট ব্যবসায়ীরা যারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতিদিনের কাজের ওপর নির্ভর করেন তাদের অবরোধের দিনগুলোয় কোনো কাজ থাকে না। ফলে দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে তাদের পরিবার নিয়ে জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। ঠিক একইভাবে কৃষকেরা তাদের কৃষিপণ্য ন্যায্য দামে বিক্রি করতে না পারায় তাদের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে যায়। আবার ভোক্তাদেরও বেশি দামে কৃষি পণ্য কিনতে হয়।

চলমান হরতাল-অবরোধ চলাকালে সড়ক পরিবহন খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। দূরপাল্লার আন্তঃজেলা বাসগুলোর অধিকাংশই এই সময় চলাচল বন্ধ আছে। সহিংসতার আশঙ্কায় ঢাকা শহরের ভেতরে বাস চলাচলও কমে গেছে। এতে করে অনেক পরিবহন শ্রমিক হরতাল-অবরোধ চলাকালে কর্মহীন থাকছেন। এইসব শ্রমিক পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে কোনো আর্থিক প্রণোদনা পাচ্ছেন বলেও সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তাদের জীবনে গুরুতর দুর্ভোগ বয়ে এনেছে।

রাজনৈতিক সংকটের কারণে যদি পণ্য যথাসময়ে উৎপাদন ও রপ্তানি করা না যায় তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে।

ঠিক একইভাবে পর্যটন খাতও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পর্যটকদের চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার জন্য। সাধারণত শীতকাল বাংলাদেশে পর্যটনের পূর্ণ মৌসুম বলে বিবেচিত হয়। অনেক পর্যটন স্পটের হোটেল, মোটেলসহ পর্যটন খাতের সঙ্গে সরাসরি বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট মানুষ এই মৌসুমের আয় দিয়ে মূলত সারা বছর চলেন।

তবে এবারে নির্বাচন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চলমান হরতাল-অবরোধ তাদের এই আয় অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যটন স্থানে হোটেলের বুকিং বাতিল হয়ে যাচ্ছে। পর্যটনের সঙ্গে যেহেতু অনেকগুলো আর্থিক খাত পারস্পরিক সম্পর্কিত তাই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সেইসব খাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকটের সঙ্গে যদি দেশের অভ্যন্তরে সংকট বা অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় তাহলে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অভ্যন্তরে জোগান বাধাগ্রস্ত হলে শিল্প উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে যার ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে।

বৈদেশিক বাজারেও পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক সংকটের কারণে যদি পণ্য যথাসময়ে উৎপাদন ও রপ্তানি করা না যায় তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও বিকল্প উৎস, যেখানে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান আছে সেইসব দেশের দিকে ধাবিত হবেন।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা কাজ করে; মাথাপিছু আয় কমে যায়; দারিদ্র্যতা দ্রুত বাড়তে থাকে; সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতি সৃষ্টি হয়; বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ কমে যায় এবং অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়।

এমতাবস্থায় প্রত্যেকটি দেশেরই উচিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যাতে করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হয় এবং একইসঙ্গে দেশকে টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে উন্নীত করা সম্ভব হয়।

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়