নতুন শিক্ষাক্রম কতটা বাস্তবমুখী?
পিএইচডির জন্য ২০০৬ সালের শেষে আমি ইংল্যান্ডের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। পরের বছরের শুরুতেই আমার সহধর্মিণী ও ছেলে আমার সাথে যুক্ত হয়। আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। বাসার পাশের শ্যারো প্রাইমারি স্কুলে তাকে ভর্তি করি।
বাংলাদেশে থাকাবস্থায় সে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছিল। দু-এক সপ্তাহ বাদে বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে ইংল্যান্ডের প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক তফাত। বইপত্র যা দেওয়া হয়েছিল তা স্কুলেই থাকতো তার নামে বরাদ্দকৃত স্থানে।
বিজ্ঞাপন
বাসায় পড়াশোনার যেন বালাই নেই। স্কুলে সে পড়তো, খেলতো, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে শ্রেণি শিক্ষকদের সাথে বাইরে গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতো এবং ফিরে এসে পরেরদিন স্কুলে এসে তার বর্ণনা দিত। এ যেন বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা। বিষয়টি প্রথম দিকে একটু বেমানান লাগতো। মানিয়ে দিতে আমার বেশ কষ্ট হতো।
আরও পড়ুন
যাই হোক, এভাবে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ শেষ করতে না করতেই আবারও ছন্দপতন। আমার পড়াশোনা শেষ। নিজ দেশে কর্মস্থলে ফিরে আসি। আমার ছেলের বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিতে শিখন পদ্ধতির দিন শেষ। আবারও শুরু হলো মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা।
বেশকিছু দিন বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মুখে নতুন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা শুনছি। যে কারণে বিষয়টি সম্পর্কে জানা ও বোঝার তাগিদ তৈরি হলো। বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে মনে হলো মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সাথে কথা বলা দরকার। সুযোগও পেয়ে গেলাম।
গাইবান্ধায় এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে কথা হলো বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে। কেউ বেশ প্রবীণ, অতিসম্প্রতি অবসরে গেছেন, কেউবা আবার দু-এক বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন, আবার কেউ মধ্যবয়সী, উনাদের দুজন এনটিআরসি-এর মাধ্যমে বছর তিনেক আগে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছেন অর্থাৎ বয়সে বেশ তরুণ। এসব শিক্ষকের মধ্যে তিনজন নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন।
আমাদের দেশে দক্ষতার সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি এখনো। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ, তাদের প্রশিক্ষণে ফাঁকি দেওয়া, প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষক মূল্যায়নে দেখাদেখি করে পরীক্ষা দেওয়াসহ নানা অনিয়মের তথ্য শোনা যায়।
শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় যে বিষয়টি আমার বোধগম্য হলো তা এমন যে, পূর্ববর্তী শিক্ষাক্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল মুখস্থ নির্ভর, আর বর্তমান শিক্ষাক্রম অভিজ্ঞতা নির্ভর। আগের শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক শ্রেণিতে পরীক্ষা দিতে হতো, আর বর্তমানে শিক্ষার্থীদের বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হবে না। বরং প্রতিদিনই তারা বাস্তব অভিজ্ঞতা নির্ভর শিক্ষা আয়ত্ত করবে এবং পরীক্ষা দেবে।
অনেক ক্ষেত্রে তারা দলগত কাজ করবে যা আগের শিক্ষাক্রমে ছিল না। নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা অন্তত তিনটি ভাগে অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যে ভাগ হয়ে যেত যা বর্তমান শিক্ষাক্রমে থাকবে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই বিষয়ে পড়তে হবে। ক্লাসে থাকবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। ধারণা করা হচ্ছে, অভিজ্ঞতা নির্ভর হওয়ায় বর্তমান শিখন ফল দীর্ঘস্থায়ী হবে। এতে করে প্রাইভেট থাকবে না।
তবে আমার আলোচনার বিষয় পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নয়। বরং আমার প্রশ্ন, বর্তমান শিক্ষাক্রম কতটা বাস্তবমুখী হবে? আমাদের দেশে বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ—এসব সার্বিক দিক বিবেচনায় এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি?
আরও পড়ুন
উন্নত বিশ্বের বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসম অনুপাত লক্ষণীয়। উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিকে প্রতি ১২ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকলেও বাংলাদেশে প্রতি ৩৪ জনে একজন শিক্ষক রয়েছে। মাধ্যমিকে সেই অনুপাত আরও বেশি।
উদ্বেগের বিষয় হলো, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যার অনুপাত কম হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে সমস্যা থাকে। কারণ ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে একজন শিক্ষক আলাদা আলাদাভাবে সব শিক্ষার্থীর প্রতি সমান মনোযোগ দিতে পারেন না। এর মধ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর প্রতিও আলাদা যত্নের প্রয়োজন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে কোনোভাবেই পাঠদানের মানদণ্ড বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
সমস্যা শুধু শিক্ষকের সংখ্যাতে বা শিক্ষা উপকরণের প্রাপ্যতায় নয়। আমাদের দেশে দক্ষতার সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি এখনো। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ, তাদের প্রশিক্ষণে ফাঁকি দেওয়া, প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষক মূল্যায়নে দেখাদেখি করে পরীক্ষা দেওয়াসহ নানা অনিয়মের তথ্য শোনা যায়। এর কারণ মনে হয় শিক্ষাক্রম বুঝতে না পারা।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ বছর সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা থাকার পরও সরকারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ৪১ শতাংশ শিক্ষকই সৃজনশীল ব্যবস্থা বোঝেননি। এই অবস্থা থাকলেও নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর আগেও ই-উপকরণ ব্যবস্থাপনার ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অর্থাৎ কয়েক বছরে যেসব বিষয়ে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তার থেকে বর্তমান শিক্ষাক্রম পুরোপুরি ভিন্ন।
তাই শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমেও শিক্ষকদের দক্ষতা না থাকা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার্থীদের ভিত্তি তৈরির জন্য যারা দায়িত্বে থাকবেন তাদের দক্ষতার এই সংকট প্রাইমারি শিক্ষাকে দ্বিগুণ প্রভাবিত করবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং শিক্ষকদের দক্ষতায় এত ফারাক রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব?
একমুখী শিক্ষা হলেও শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ ও গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষা উপকরণ সমানভাবে বণ্টন করা যায়নি। বেশিরভাগ বিষয়ের জন্য পাঠ সহায়ক উপকরণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাওয়া যায় না।
নতুন শিক্ষাক্রমে যেহেতু পাঠ্যবইয়ের চেয়ে প্রায়োগিক শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে সেই কারণে শিক্ষা উপকরণ অন্যতম জরুরি অনুসর্গ। পাঠদান প্রক্রিয়ার সাথে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করা, পাঠদান গ্রহণযোগ্য করা ও শিক্ষাদানকে ফলপ্রসূ ও স্থায়ী করতে শিক্ষা সহায়ক উপকরণের বিকল্প নেই। কারণ এসব উপকরণ শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
যদি শিখন ফল দীর্ঘস্থায়ী করতে হয় তাহলে কঠিন বিষয়গুলো উপকরণের সহায়তায় সহজে উপস্থাপন ও অনুধাবন যোগ্য করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, একমুখী শিক্ষা হলেও শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ ও গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষা উপকরণ সমানভাবে বণ্টন করা যায়নি। বেশিরভাগ বিষয়ের জন্য পাঠ সহায়ক উপকরণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাওয়া যায় না।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, সাউন্ডবক্স, বিজ্ঞানাগার প্রয়োজন। তবে এসব উপকরণ আছে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যথেষ্ট অপ্রতুল। এছাড়া দক্ষ শিক্ষক না থাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞানের পাঠদান সহজ নয়। এমপিওভূক্ত মাধ্যমিক, নিম্নমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মরিচা ও বায়ুস্থিত বিভিন্ন পদার্থের সংস্পর্শে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার খবর পাওয়া যায় গণমাধ্যমে।
আরও পড়ুন
একদিকে উপকরণ সংকট অন্যদিকে উপকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতার শূন্যতা কী উপায়ে পূরণ করবে নতুন শিক্ষাক্রম? শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ছাপিয়ে যে ভবন, পরিবেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করছে তাও কি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা পরিবেশ দিতে পারছে?
অপর্যাপ্ত ভৌত অবকাঠামো সৃষ্টি করেছে শিক্ষা খাতের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। জনাকীর্ণ শ্রেণিকক্ষগুলোয় কার্যকর শিক্ষাদানে সমস্যাসহ শিখন ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা, উদ্ভাবনী পদ্ধতির শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হয়। এছাড়া দুর্বলভাবে নির্মিত ভবনগুলো নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দুশ্চিন্তা শিখন পরিবেশে প্রভাব ফেলে তথা শিক্ষকের মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
একই সাথে অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধাগুলো স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, সাড়ে ১০ হাজার সরকারি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠসহ মৌলিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিনোদনমূলক স্থানের অভাব রয়েছে। এসব অভাব শিক্ষার্থীদের কল্যাণ এবং বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে।
নতুন শিক্ষাক্রমে বেশকিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও এসব সংকট রেখে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের একটি শিক্ষাক্রম কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে? তাহলে উপায় কী? বা এই পরিস্থিতি উত্তরণে কোনো পদক্ষেপ কি নেই?
তার উত্তর কিছুটা পাওয়া যায় সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফলে। গবেষণাটির তথ্য বলছে, প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো অপর্যাপ্ত সরকারি তহবিল। এর ফলে যেমন প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক/প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়া স্কুলগুলোয় পর্যাপ্ত কর্মীর অভাব থেকে যাচ্ছে এবং নিরাপত্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা বাড়ানো যাচ্ছে না। এর অর্থ শিক্ষা খাতের বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমেই উল্লিখিত সমস্যাগুলো অনেকাংশে সমাধান সম্ভব।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়