ছবি : সংগৃহীত

সরকারি হাসপাতালই স্বল্প আয়ের মানুষের ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্য সেবার মূল ভরসা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের বহুমুখী সীমাবদ্ধতা আমাদের অজানা নয়। উপযুক্ত জনবল এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর অপর্যাপ্ততাসহ নানা সংকটে বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালই সেবাদানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।

অন্যদিকে রয়েছে আর্থিক বরাদ্দের অপর্যাপ্ততার পাশাপাশি প্রাপ্ত বরাদ্দ পুরোপুরি এবং সঠিকভাবে ব্যয় করতে না পারা। ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্য সেবার প্রথম ধাপে অর্থাৎ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।

তাই অনেক মানুষ ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্য সেবার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবর্তে উচ্চতর সেবা কেন্দ্রে (যেমন জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা বিশেষায়িত হাসপাতাল) ভিড় করে। ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় বেড খালি থাকে, অথচ উচ্চতর সেবা কেন্দ্রে বেড সংখ্যার দেড় থেকে তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি হতে দেখা যায়। তাই উচ্চতর সেবাকেন্দ্র গুণগত সেবা দিতে পারে না। 

এক গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চতর সেবা কেন্দ্রের পরিবর্তে যদি নিকটবর্তী সেবা কেন্দ্র (যেমন উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা জেলা হাসপাতাল) থেকে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারতো তাহলে ব্যক্তির যে পরিমাণ অর্থ এবং সময় সাশ্রয় হতো তার মূল্য বছরে চার হাজার কোটি টাকার বেশি।

 

অন্যদিকে, ব্যক্তির পকেট থেকে স্বাস্থ্যের ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫ -৬ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্য সীমার নিচে  পতিত হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি দিয়ে বছরে যতটুকু দারিদ্র্য বিমোচন হয়, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের খরচ মেটাতে গিয়ে  তার থেকে বেশি পরিবার দারিদ্রে পতিত হয়।  

স্বাস্থ্যে বিনিয়োগকে দারিদ্র্য দূরীকরণের কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করলে এতদিন দারিদ্র্য সিঙ্গেল ডিজিটে আনা সম্ভব হতো। স্বল্প আয়ের মানুষের ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্য সেবা সহজতর করার মাধ্যমে দারিদ্র্যে পতিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের পথ খুঁজতে হবে।

রাষ্ট্র বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে কত অর্থ খরচ করছে তা জানা, কিন্তু সেই অর্থ বরাদ্দের পর জনগণ কতখানি সেবা পাচ্ছে তা রাষ্ট্রের জানা নেই।

এই ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তা হলো বর্তমান প্রচলিত 'ইমপ্লিসিট বেনিফিট প্যাকেজ'-কে এক্সপ্লিসিট বেনিফিট প্যাকেজ-এ রূপান্তর করে প্রতিটি পরিবারের জন্য বছরে ন্যূনতম এক লাখ টাকার ইনপেশেন্ট চিকিৎসা সেবা দেওয়ার অঙ্গীকার করা। এতে জনগণকে ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতে ক্ষমতায়িত হবে, যা সেবাদানকারীসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিতে তাড়িত করবে।

তাছাড়া মানুষ কত টাকার সেবা পেল তা জানার পাশাপাশি রাষ্ট্র কত টাকার স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে তাও জানা সম্ভব হবে। ফলে সরকার স্বাস্থ্যখাতে টাকা খরচে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

রাষ্ট্র বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে কত অর্থ খরচ করছে তা জানা, কিন্তু সেই অর্থ বরাদ্দের পর জনগণ কতখানি সেবা পাচ্ছে তা রাষ্ট্রের জানা নেই। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে জনগণ নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে সেবা নিতে উৎসাহিত হবে।

কেননা নির্দিষ্ট সেবা কেন্দ্র বাইপাস করে উচ্চতর সেবা কেন্দ্রে সেবা নিতে গেলে স্বাস্থ্য কার্ডের প্রদত্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে এবং তাকে নির্ধারিত মূল্যে সেবা কিনতে হবে। ফলে কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি চালু করা সহজ হবে। 

স্বাস্থ্যখাতের অবয়ব, কলেবর, কাঠামোগত জটিলতা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতাসহ বহুমুখী বৈশিষ্ট্য আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের নিকট সমন্বিতভাবে বোধগম্য নয়।

ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ যেসব দেশ এক্সপ্লিসিট বেনিফিট সম্বলিত প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে তারা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এগিয়ে  গেছে। যেমন ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রোগ্রামের আওতায় ভারতে পরিবার প্রতি বছরে পাঁচ লাখ রুপির ইনপেশেন্ট সুবিধা সম্বলিত 'প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য ইয়াযোজনা' কর্মসূচি চালু করেছে।

থাইল্যান্ড 'ইউনিভার্সাল কাভারেজ স্কিম' চালু করেছে এবং ইন্দোনেশিয়া সবার জন্য একই সুবিধা সম্বলিত স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি দেশ একটি শক্তিশালী স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে।

ভারত প্রচলিত আইনি কাঠামোর আওতায় 'ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি' গঠন করেছে। তবে, স্বাস্থ্যখাতের জন্য পাবলিক-ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট রুল নমনীয় করে সরকারি হাসপাতালকে সেবার গুণগত মান উন্নয়নে সেবা থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করার এখতিয়ার প্রদান করেছে।

অন্যদিকে, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়া পাবলিক-ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট রুল নমনীয়তার বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। ফলে এসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তারা এটা করতে পেরেছে কারণ তারা স্বাস্থ্য ব্যয়কে উন্নয়নের কৌশল হিসেবে বিবেচনা করতে পেরেছে।

বাংলাদেশেও এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রত্যয় ২০১২ সালে প্রণীত 'হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্রাটেজি'-তে উল্লেখ আছে। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আমরা তা এখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। 

প্রধান কারণ হলো আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের স্বাস্থ্যখাত এবং এই খাতের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিখাদ এবং সামগ্রিক ধারণার অভাব। স্বাস্থ্যখাতের অবয়ব, কলেবর, কাঠামোগত জটিলতা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতাসহ বহুমুখী বৈশিষ্ট্য আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের নিকট সমন্বিতভাবে বোধগম্য নয়। 

তবে 'ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি’ গঠনের প্রয়োজনীয়তা, এর কার্যপরিসর, গঠন কাঠামো, অর্থায়ন, গভর্ন্যান্স এবং পরিচালন ইত্যাদি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট সম্প্রতি একটি গবেষণা সম্পন্ন করেছে।

স্বাস্থ্যখাতের জন্য পাবলিক-ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট রুল নমনীয়তার বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে 'ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি' গঠনের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। আর এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়কে নিছক খরচ  না ভেবে উন্নয়নের কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক