ছবি : সংগৃহীত

মশাবাহিত সংক্রামক রোগ ডেঙ্গু বিশ্বব্যাপী ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ৫০ বছরে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বেড়েছে। সংক্রমণ প্রধানত উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুযুক্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে প্রকট। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘন ঘন ভ্রমণ ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণকে ত্বরান্বিত করে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ভৌগলিক বিস্তার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা মশার প্রজনন ও রোগ বিস্তারের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে এবং করবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিলো তিন লক্ষ ১৪ হাজার মানুষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে ১৬৩২ জন। শীত মৌসুম নভেম্বরে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৪১ হাজার। ডিসেম্বরেও থেমে নেই সংক্রমণ। 

উপযোগী তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত হলো অন্যতম দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—যা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ফাইলেরিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ বা ত্বরান্বিত করে। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন গবেষকের ল্যাবরেটরি এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় ভেক্টরের বৈশিষ্ট্যে, কামড়ের হার, আচরণগত পরিবর্তন, ভাইরাস বা অন্যান্য প্যাথোজেনের ইনকিউবেশন হার ইত্যাদির ওপর তাপমাত্রার প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে।

বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মশার জীবন চক্রে ডিম, লার্ভা এবং পিউপা দশা সরাসরি সম্পৃক্ত। থেমে থেমে বৃষ্টি, বিশেষ করে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। অন্যদিকে ভারী বৃষ্টিপাত মশার প্রজননের জন্য অনুপযোগী। ভারী বৃষ্টিপাত হলে মশার প্রজননস্থল ভেসে গিয়ে ডিম, লার্ভা বা পিউপা মারা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের মৌসুম এবং ধরন পরিবর্তন ডেঙ্গুর মৌসুমকে প্রলম্বিত করেছে। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে ঘটেছে তা নয়। বিশ্বব্যাপী উষ্ণ আদ্রিয় দেশগুলোয় মশাবাহিত রোগের বিস্তার বেড়ে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের মৌসুম এবং ধরন পরিবর্তন ডেঙ্গুর মৌসুমকে প্রলম্বিত করেছে। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে ঘটেছে তা নয়….

পৃথিবীর অনেক গবেষক আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে রোগ সংক্রমণের সংযোগের সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করেছেন এবং সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে আছেন। গবেষকরা অনুমান করছেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাহক মশার ভেক্টরিয়াল ক্যাপাসিটি বা রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে। একটি গবেষণা হুঁশিয়ারি প্রদান করেছে যে ম্যালেরিয়ার বাহক মশা সুপার পতঙ্গে রূপান্তরিত হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি বা মহামারি নয় এর ভৌগোলিক বিস্তারও বাড়াবে। যেসব দেশে মশাবাহিত রোগ ছিল না সেইসব দেশেও রোগ বিস্তার ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শীত প্রধান ইউরোপেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে যা ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজনন এবং এর মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের কিছু কিছু দেশে মশাবাহিত রোগ বিশেষ করে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং এর জটিল প্রভাবে রোগ সংক্রমণ, মহামারির ধরন, আকার এবং সময় ইত্যাদি পরিবর্তিত হবে। আগে বাংলাদেশে ডেঙ্গু নির্দিষ্ট মৌসুমে হতো। বিশেষ করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ছিল ডেঙ্গুর মৌসুম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুই বছর ধরে নভেম্বর-ডিসেম্বরে হচ্ছে ও প্রচুর মানুষ বাংলাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে।

নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের তুলনায়, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলো ভবিষ্যতে ডেঙ্গু জ্বর বাহক এডিস মশার জন্য আরও অনুকূল অবস্থা তৈরি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণ ভিন্নভাবে আচরণ করতে পারে। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের অনিয়ন্ত্রিত ডেঙ্গু সংক্রমণ এবং মৃত্যু এটাই প্রমাণ করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব গবেষণাগার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে মশা এবং মশাবাহিত রোগ আরও জটিল আকার ধারণ করবে।

আমাদের গবেষণা মডেল বলছে, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মশা এবং মশাবাহিত রোগ বেশ জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে। বাহক বাহিত রোগ এখন আর মৌসুম মেনে হবে না, সারা বছরই রোগ সংক্রমণ দেখা যাবে।

ভবিষ্যতে মশা এবং মশাবাহিত রোগ আরও জটিল আকার ধারণ করবে। সারা বছরই রোগ সংক্রমণ দেখা যাবে….

নভেম্বর ৩০ থেকে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ-কপ ২৮ অনুষ্ঠিত হয়েছে দুবাইয়ের এক্সপো শহরে। ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত চলবে এই সম্মেলন। কপ ২৮-এ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় স্থান পাবে বলে আশা করছি।

তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে ২০৩০ সালের মধ্যে সমাধানের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কপ ২৮ সম্মেলনে যাওয়ার পূর্বে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ইউএনডিপি এবং ইউকে-এর সহায়তায় সংলাপের আয়োজন করেছিলেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে কোন বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরবেন তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করে তিনি সম্মেলনে গিয়েছেন।

সেই সংলাপে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মশা এবং মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধি এবং তা প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বিষয়টি আমি আলোচনা করেছি। নিশ্চয়ই কপ ২৮ সম্মেলনে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হবে এবং বাংলাদেশ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা পাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবকে বিবেচনায় রেখে মশা বা মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। দরকার হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষকদের নিয়ে কর্মশালা করে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। টেকসই এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশকে মশা এবং মশাবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com