ছবি : সংগৃহীত

বায়ু দূষণের বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ১৯৯৮ সালের তুলনায় বায়ু দূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।

আমাদের আশপাশের দেশগুলো যাদের একসঙ্গে ইন্দো গাঙ্গেটিক প্লেইন (আইজিপি) বলে, সেইখানে বাংলাদেশসহ আছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল—এইসব দেশ। আইজিপির এসব দেশের বায়ু দূষণ কাছাকাছি। তবে আফ্রিকার চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ। আর আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণ দিনদিন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষের জীবন। গবেষণা বলছে, বৈশ্বিক বায়ু দূষণের হটস্পট হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত চারটি দেশ এবং দূষণের শীর্ষে থাকা ১০ শহরের মধ্যে নয়টির অবস্থানই এই অঞ্চলে।

বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রা, প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে কম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ থাকতে হবে। এমনকি বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব মানমাত্রা হিসাবে পিএম-২.৫ ঘনমিটারে ১৫ নির্ধারণ করেছে। সবচেয়ে নির্মল বায়ুর জেলা সিলেটেও এর চেয়ে বেশি মাত্রায় বায়ুদূষণ থাকছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। বায়ুমান সূচক ২০২০ অনুযায়ী, শীর্ষ দূষিত ১০০ শহরের মধ্যে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ঢাকার আজিমপুর ও গাজীপুরের শ্রীপুরের অবস্থান যথাক্রমে ১৬, ২৩, ৬০ ও ৬১ নম্বরে।

ওই জেলাতেও ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রায় ১০ গুণ বেশি। আর বাংলাদেশের নিজস্ব মানমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের বায়ুতে ব্ল্যাক কার্বনের উপস্থিতির পরিমাণ সেইসব দেশের তুলনায় ১০০ বা ১২০ গুণ বেশি।

দেশে বায়ু দূষণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এরপরই অবস্থান বরিশাল বিভাগের। ঢাকায় যানবাহন ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ু দূষণে বড় ভূমিকা রাখে। ঢাকার বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ৪৮ দিন ছাড়া বছরের বাকি ৩১৭ দিন ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে।

গবেষণা বলছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বাতাসের মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। জানুয়ারিতে মোট ৯ দিন রাজধানীর বাতাসের মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা সর্বশেষ সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বর্ষার সময় সাধারণত বায়ু দূষণ কম থাকে। কিন্তু এবার বর্ষা মৌসুম বা জুলাই-আগস্টে বায়ুর দূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এমনকি ২০২৩ সালের আগস্টে বায়ু দূষণ আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ঢাকার বাতাসে ক্যাডমিয়াম প্রায় ২০০ গুণ বেশি, নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়াম প্রায় ৩ গুণের বেশি। সিসা দূষণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এর ফলে বছরে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে। শিশুদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব মানমাত্রা হিসাবে পিএম-২.৫ ঘনমিটারে ১৫ নির্ধারণ করেছে। সবচেয়ে নির্মল বায়ুর জেলা সিলেটেও এর চেয়ে বেশি মাত্রায় বায়ুদূষণ থাকছে।

সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকায় বায়ু দূষণের বড় উৎস। এসবের উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলা নির্মাণ কাজ, পুরোনো যানবাহনের ধোঁয়া। এছাড়া আছে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ু, যা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

বায়ু দূষণ যেহেতু চোখে দেখা যায় না, ফলে তার ক্ষতির পরিমাণটি বোঝা কঠিন। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা থেকে ক্যানসার, হৃদরোগ, বহু প্রাণঘাতী অসুস্থতার জন্য বায়ু দূষণ প্রত্যক্ষভাবে দায়ী এবং বায়ু দূষণজনিত কারণে প্রতি বছর গোটা দুনিয়ায় চার কোটি মানুষ প্রাণ হারান—তাদের প্রতি চার জনে একজন দক্ষিণ এশীয়।

ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউয়ের) পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির প্রস্তুতকৃত (ইইএ) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫ বস্তুকণার পরিমাণ সহনীয়মাত্রা অতিক্রম করায় ২০২১ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মারা গেছেন ২ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ। এছাড়া নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড এবং ওজন গ্যাসের দূষণে মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে ৫২ হাজার এবং ২২ হাজার মানুষের।

গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোকসহ ১৪ ধরনের হৃদরোগ—ফুসফুস, স্তন, মূত্রথলির ক্যান্সার; সিওপিডি, হাঁপানি, ফুসফুস সংক্রমণ; চর্মরোগ, অ্যালার্জি; ৯ ধরনের চোখের অসুখ; সংক্ষিপ্ত গর্ভাবস্থা, বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত ঋতুচক্র; শিশুর জন্মকালীন রুগ্নতা ও বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া; স্নায়ু বৈকল্য, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমারস; অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ বহু রোগের সঙ্গে বায়ু দূষণের সম্পর্ক রয়েছে।

সম্প্রতি সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) নামক রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রোগটি বাংলাদেশে মৃত্যুর তৃতীয় কারণ। এই রোগের সঙ্গে বায়ুদূষণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বায়ু দূষণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। ঢাকাবাসীর গড় আয়ু কমেছে সাড়ে ৭ বছর।

অতিরিক্ত বায়ু দূষণের খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বায়ু দূষণ বেশি, সেইখানের মানুষ বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়।

এই অসুস্থতার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বিপুল; মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বিপদের সামনে নাগরিক জীবন সম্পূর্ণ অসহায়। বায়ু দূষণ থেকে বাঁচার উপায় মানুষের নেই। ফলে, এই বিপদটি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য।

এক যুগে বিশ্বে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে চীন সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে। দেশটি দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দূষণ রোধে তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করেছে। দূষণকারী শিল্পকারখানার সংখ্যা কমিয়েছে। রাস্তায় পানি ছিটানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এতে দেশটির বায়ুর মান ৪২ শতাংশে বেশি উন্নতি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বায়ুর মানের উন্নতি করেছে। দেশটি ১৯৭০ সালের তুলনায় বায়ুর মান ৬৫ শতাংশ উন্নতি করেছে। বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা এক বছর চার মাস বেশি বাঁচে। এর কারণ দেশটি নির্মল বায়ু আইন করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে।

বায়ুর মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে ইউরোপের দেশগুলো। এখানকার অধিবাসীরা ১৯৯৮ সালের তুলনায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ ভালো বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে। এখানকার বেশিরভাগ দেশ এয়ার কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক ডিরেক্টিভ তৈরি করেছে। ওই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বায়ু দূষণ শুধু মানুষের ক্ষতি করছে না। গবেষকরা বলছেন, বায়ু দূষণের ফলে গোটা জীবজগৎ (প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীব) এবং বাস্তুতন্ত্রেরও ক্ষতি হচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া পরীক্ষায় প্রমাণিত যে বায়ু দূষণ স্থাপনারও ক্ষতি করে। ভবন, ভাস্কর্য, বিশ্ব ঐতিহ্যের নানা স্থাপনাও বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে—এটি এখন এক কঠিন সত্য। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসে মিশছে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি।

গবেষণা প্রতিবেদনে এক দশকে (২০১১-২০২০) ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০-এর চেয়ে ১.০৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের কর্মকাণ্ডই পৃথিবীর জল, স্থল ও বায়ুমণ্ডলকে আশঙ্কাজনকভাবে উত্তপ্ত করে তুলছে।

আবার প্রযুক্তিপণ্যের উচ্ছিষ্ট বর্জ্যগুলো মাটি, বায়ু ও পানিকে দূষিত করছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক অভিঘাত বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের অবনমন ঘটছে, যার নেতিবাচক অভিঘাত পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে জীববৈচিত্র্যের মহাবিলুপ্তির দিকে।

বায়ু দূষণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। ঢাকাবাসীর গড় আয়ু কমেছে সাড়ে ৭ বছর...

বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড—কলকারখানা, যানবাহন ইত্যাদিতে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি। দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে তিনটি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আছে যানবাহনের ধোঁয়া। যানজটের কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের ধোঁয়া বাড়ছে।

এরপরই রয়েছে শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্টি হওয়া ধুলা। এরপর দূষণের জন্য ইটভাটার ধোঁয়াকে দায়ী করা হয়েছে। যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ু দূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয়, তা ১৩৬ শতাংশ বেশি।

বায়ু দূষণ দিন দিন ভয়ংকর হয়ে ওঠার কারণে জাতিসংঘ এর নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব জনসচেতনতা তৈরির জন্য ২০১৯ সালে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস করে। সেই অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ৭ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ক্লিন এয়ার ফর ব্লু স্কাই’। প্রকৃতপক্ষে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মানবসৃষ্ট উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর এর জন্য আইন তৈরি, তার যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতাও দরকার।

বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য নির্মল 'বায়ু আইন ২০১৯' এর প্রয়োগ, সবুজ আন্দোলনসহ নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি—

  • ত্রুটিপূর্ণ ও কালো ধোঁয়া উৎপাদন করে এমন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করা।
  • ইটের ভাটা লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করা। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলো জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা।
  • কম জ্বালানি ব্যবহার হয় এমন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
  • ধূমপান না করা।
  • উন্নত চুলা ব্যবহার করা।
  • বনভূমি সংরক্ষণ করা ও নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা।
  • সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বায়ু দূষণের পরিমাণ বাইরের বায়ু দূষণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। এসি ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
  • সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ বহিরঙ্গের বায়ু দূষণের চেয়ে অধিকমাত্রায় বেশি। তাই বায়ুমান নিশ্চিত করা জরুরি।
  • বায়ু দূষণের কারণে রোগাক্রান্তদের সুচিকিৎসার জন্য সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
  • সবুজ করের প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মূল নীতি হবে ‘যারা কলুষিত করবে বা দূষণ করবে, তারা কর প্রদান করবে।’
  • অতিমাত্রায় দূষিত বায়ুর শহরগুলোয় ‘স্মগ টাওয়ার’ স্থাপন করা যেতে পারে।
  • নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই বায়ু দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের সব উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

এই অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের সংবেদনশীল হতে হবে এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। উন্নয়ন সংক্রান্ত সব নীতিমালায় পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখেই আমাদের পরিকল্পনা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বায়ু দূষণ এখন রাষ্ট্রের বড় সমস্যা। রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হতে হবে। সামনেই জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহার দেয়।

আমরা মনে করি, প্রতিটি দলের ইশতেহারে থাকা উচিত, পরিবেশ বা বায়ু দূষণ রোধে আমরা কাজ করব। দেশকে বায়ু দূষণমুক্ত করব। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই দূষণের জন্য আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী। তাই জনমনে চেতনা জাগাতে হবে। প্রতি নাগরিকের অংশগ্রহণ ছাড়া বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ এক অলীক স্বপ্ন।

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu