মেলা শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখে যে ছবিটি আসে, তা হলো বড় বট-পাকুড়ের গাছকে কেন্দ্র করে আশপাশে সারি-সারি এলোমেলো অস্থায়ী দোকানের চিত্র। যেখানে থরে-থরে সাজানো আছে মাটি-বাঁশ-বেত-কাঠ-পাটসহ দেশি কাঁচামালে তৈরি নিত্য ব্যবহার্য, খেলনা, কৃষিজ নানা লোকজ খেলা, মুড়ি-মুড়কি-খৈ-জিলাপি সঙ্গে আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা। এই ছবির সঙ্গে অবশ্য স্মরণকালে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিকের নানা পণ্য। আর আছে মেলা আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতা। এর মধ্যে হিন্দু, মুসলমান অথবা অন্যান্য ধর্ম তো আছেই সেই সঙ্গে আছে নানা পার্বণ, সামাজিক, প্রাকৃতিক কারণও। যার হেতু ধরে মেলা আয়োজিত হয়ে থাকে। মাঠে দোকানের সারিতে, প্রতিটা মেলার রূপ প্রায় সমান। তবে অন্দরে চলে পার্বণের আনুষ্ঠানিকতা। এই পার্বণই প্রতিটা মেলার নিজস্ব রূপ দেয়। মেলার ইতিহাসে বৈশাখী মেলার আছে বিশেষ স্থান। বাংলা সনে বৈশাখ মাস হিসেবে যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই, শস্য তোলার মাস হিসেবে মেলা-পার্বণে উদযাপিত মাস ছিল এই সময়টা।

১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর প্রবর্তন করেন, তার আগে থেকেই মেলা প্রচলিত ছিল তো বটেই। মেলার প্রচলন ধরে নেওয়া হয় আরও প্রাচীন থেকে প্রাচীন সময়ে।

আদি যুগে ফল-মূল-লতা-পাতা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ ছাড়া পশু শিকার ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। মানুষ গোত্রে-গোত্রে ভাগ হয়ে গুহা অথবা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় বাস করতো। তখনো তারা শিকারের প্রয়োজনে একত্রিত হতো, শিকার শেষে হর্ষধ্বনি আর উল্লাসে উদযাপন করতো তাদের সফল স্বীকার যাত্রা। যা মেলারই প্রাচীন রূপ ধরে নেওয়া যায়।

মাঠে দোকানের সারিতে, প্রতিটা মেলার রূপ প্রায় সমান। তবে অন্দরে চলে পার্বণের আনুষ্ঠানিকতা। এই পার্বণই প্রতিটা মেলার নিজস্ব রূপ দেয়। মেলার ইতিহাসে বৈশাখী মেলার আছে বিশেষ স্থান।

খ্রিস্টপূর্ব ২০,০০০ অব্দ থেকে মানুষ বন্য শস্যাদি খেয়ে জীবন যাপন করতো। সেই প্রাচীন যুগেই দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার নাটুফিয়ান সংস্কৃতি ও চীনের নিউলিথিক বিপ্লব শস্য চাষ পদ্ধতির প্রমাণ। অবশ্য অনেকে মনে করেন, পূর্বেও শস্যাদি রোপণ করা হত কিন্তু চাষের উদ্দেশ্যে নয়। তবে লেভ্যান্ট-এ বরফ যুগের পর আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১,০০০ অব্দে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়া বীজ বরফের নীচে থেকে সুপ্ত হয়ে ওঠতো। এই সময়ে দল বেঁধে শস্য ও সবজি সংগ্রহের নিয়ম ছিল। ফসল সংগ্রহের সেই উদযাপিত আয়োজন ও মেলা ছিল। মজুদকৃত বন্য শস্যাদি ও ডাল জাতীয় উদ্ভিদ পাওয়া যায়, এমন এলাকায় পশু শিকারিদের একত্রিত করে  প্রথম গ্রাম বা সমাজ গড়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে বিনিময় প্রথা প্রচলন হলে হাট বা বাজার সৃষ্টি হয়, দিনক্ষণ ধরে নিয়মিত এই হাট বা বাজার বসতো। যা মেলার প্রাচীন ও প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ অব্দ সময়কালে সুমেরীয় কৃষকেরা যব ও গম জাতীয় শস্য উৎপাদন করে। শুরু হয় এই সমতটের প্রকৃতি চর্চা বা শস্য উৎপাদন পদ্ধতি। শস্য উৎপাদনের পর তা প্রথমেই মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ করা হতো। নানা গোষ্ঠী উৎপাদিত প্রথম খাদ্যশস্য নানা শক্তির প্রতি উৎসর্গ করার প্রচলন ছিল। আর সেই সব উৎসর্গানুষ্ঠান বা পার্বণকে উপলক্ষ করে জমে উঠতো লোকসমাগম আর বেচা-বিক্রি-আনন্দ-বিনোদন। বলা যায় থিতু হওয়া সামাজিক মনুষ্য সমাজে সেই ছিল প্রথম মেলা-পার্বণ। সেই সময়েও মেলা বা পার্বণসমূহ ছিল শস্য তোলা বা শস্য রোপণ কেন্দ্রিক।

গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে বিনিময় প্রথা প্রচলন হলে হাট বা বাজার সৃষ্টি হয়, দিনক্ষণ ধরে নিয়মিত এই হাট বা বাজার বসতো। যা মেলার প্রাচীন ও প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ভারতবর্ষে মুঘল শাসন থিতু হলে জমিদার-জোতদার-জমির মালিকরা ফসলী সনের প্রথম মাসে বা ফসল তোলার পর খাজনা দিতে যেত। এই খাজনা দেওয়ার সময় ছিল একটি নির্দিষ্ট দিন বা একাধিক দিন। খাজনা দেওয়াকে উপলক্ষ করে সম্রাটের দরবারে জমিদারদের আগমন এবং জমিদারের দরবারে কৃষকের আগমন মেলায় রূপ নিত। বলা যায় বাংলা সন প্রবর্তনের আগেও ফসল কাটার মৌসুমে ভারতবর্ষে মেলার প্রচলন ছিল। বৈশাখ মাস স্ব-মহিমায় এই সমতটের মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিলেও এর প্রতিষ্ঠা ইতিহাস ছিল দীর্ঘ।

মুঘল আমলে ফসলী সন চালু হলে তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা তাদের বছরের হিসাব গোছাতে এবং সারা বছরের বাকি-বাট্টা আদায় করতে সম্রাটের আয়োজনের ন্যায় ছোট আকারে আয়োজন করতে শুরু করলো যার নাম শুভ হালখাতা, হাট-বাজারের প্রতিটি দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই হয়ে থাকে শুভ হালখাতা। বলা যায়, পহেলা বৈশাখে প্রতিটি হাটেই বসে মেলা। সারা বছরের বেচা-বিক্রির পুরনো খাতার হিসাব বন্ধ করে। নতুন লাল সালু কাপড়ের মলাটে বাধাই খাতায় নতুন বছরের হিসাব শুরু করা বা হালনাগাদ করার নামই হালখাতা। এই শুভ হালখাতা ও বৈশাখের মেলার অন্যতম অংশ।

বৈশাখ আমের-শাঁখের মাস, বৈশাখ স্নান কৃত্যের মাস, বৈশাখ ব্রতচারের মাস, বৈশাখ মধু মাস, বৈশাখ মেলা-পার্বণের মাস। ব্রত পার্বণের কথাই যদি ধরা হয়, এই মাসে পালিত হয় পুণ্যিপুকুর ব্রত, অশ্বত্থ পাতার ব্রত, গোকল ব্রত, হরিষ মঙ্গল ব্রত, পৃথিবী পার্বণের ব্রত, দশ পুতুল ব্রত, শিবপূজা ব্রত, জল-সংক্রান্তি ব্রত, অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত, বৈশাখ চম্পক ব্রত।

বাংলা একাডেমির এক হিসাবে বাংলাদেশে বৈশাখ মাসে আয়োজিত মেলার সংখ্যা ২৪৫টি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প করপোরেশনের অন্য এক হিসাবে দেশে বৈশাখ মাসের মেলা ২৭০টি। বাংলা নববর্ষ, বর্ষবরণ, বৈশাখী মেলা, হালখাতা মেলা যে নামেই বলা হোক না কেন, এসবই বৈশাখী মেলা হিসেবে আয়োজিত হয়। এছাড়া চৈত্রের শেষ দিন সংক্রান্তি উপলক্ষে বসা মেলা সমূহ যেহেতু বৈশাখ পর্যন্ত চলে, কাজেই সংক্রান্তি এবং চড়ক পূজার মেলাকেও বৈশাখের মেলা হিসেবেই যুক্ত করা যৌক্তিক। মেলা নিয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে এই ধারনায় আসা যায়, শুধু বৈশাখ মাসেই বাংলাদেশে প্রায় হাজারের অধিক জায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। 

ইমরান উজ-জামান ।। পরিব্রাজক ও গবেষক
imranbtv1@gmail.com