ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলাদেশে এগারোটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুরুতেই বলা ভালো, এগারোটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক হয়নি সব নির্বাচন। নির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল অংশগ্রহণমূলক। বাকি নির্বাচনগুলো কোনো না কোনো দল বা একাধিক দল বর্জন করেছে।

শুরুতে ১ হাজার টাকা জামানত দিয়ে শুরু হয়ে এখন একজন প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে জামানত দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা।

প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। দিনটি ছিল বুধবার। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ১৪। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ১০৯১ জন। ভোট পড়েছিল ৫৩.৫৪ শতাংশ।

অংশগ্রহণকারী ১৪টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে পেয়েছিল ২৯২ আসন। সংরক্ষিত ১৫ মহিলাসহ এই সংসদে তাদের প্রতিনিধি ছিল ৩০৭।

এই নির্বাচনে দলটির ১১ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। বাকি দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৩টি, ন্যাপ (ভাসানী) ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং স্বতন্ত্র ৩ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সব ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ ছিল।

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন

জিয়াউর রহমানের অধীনে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, রোববার। অংশ নেয় ২৯টি রাজনৈতিক দল। মোট ভোট পড়েছিল ৫১.২৮ শতাংশ। এই নির্বাচনের জামানত ছিল ২ হাজার টাকা।

বিএনপি বিজয়ী হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ নির্ধারণ করে। নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে ২২০টি পায়। এর সঙ্গে সংরক্ষিত ৩০টি আসন যোগ হয়ে মোট আসন দাঁড়ায় ২৫০টি।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পায় ৩৯টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ১২টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ৮টি, ইসলাম ডেমোক্রেটিক লীগ ৬টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, জাতীয় লীগ ২টি, গণফ্রন্ট ২টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, জাতীয় একতা পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফফর) ১টি করে আসন পায়। এছাড়া স্বতন্ত্র ৫ জন এমপি নির্বাচিত হন।

এই সময় থেকেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।

তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে এই সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে, বুধবার। অংশ নেয় ২৮টি রাজনৈতিক দল। ভোটের হার ছিল ৫৯.৩৮ শতাংশ। জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। দিনটি ছিল বুধবার। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ১৪। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সব ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ ছিল।

বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। জাতীয় পার্টি ১৮৩ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। ৭৬ আসন নিয়ে বিরোধী দলে ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

তাদের বাকি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১০টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৬টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৫টি, মুসলিম লীগ ও জাসদ (রব) ৪টি করে, ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) ও জাসদ (সিরাজ) ৩টি করে, ন্যাপ (মোজাফফর) ২টি এবং স্বতন্ত্র ৪টি মোট ৩০০টি।

চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ, বৃহস্পতিবার চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এই নির্বাচনে ৮টি রাজনৈতিক দলের অধীনে ৯৭৭ জন প্রার্থী অংশ নেন। ভোট পড়েছিল ৫৪.৯৩ শতাংশ। জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।

এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন পায়। সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, ফ্রিডম পার্টি ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পায় ২৫টি আসন।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৫টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়। ভোট পড়ার হার ছিল শতকরা ৫৫.৫৪ শতাংশ। এই নির্বাচনেও প্রার্থীদের জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।

বিএনপি আসন পায় ১৪০টি (সংরক্ষিত-২৮টি)। আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, সিপিবি ও বাকশাল ৫টি করে, ন্যাপ (মোজাফফর), জাসদ (সিরাজ), এনডিপি, ইসলামী ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক পার্টি ১টি করে, জামায়াতে ইসলামী ১৮টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে বিজয়ী হোন।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

এই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। অংশগ্রহণকারী ৪২টি দলের বিপরীতে প্রার্থী ছিল ১ হাজার ৪৫০ জন। এই নির্বাচনে ৫ কোটি ৬৭ লাখ ২ হাজার ৪২ জন ভোটারের মধ্যে তাদের ভোট দেন ১ কোটি ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৪৮১টি।

আওয়ামী লীগসহ অনেকে অংশ না নেওয়ায় এই সংসদের বিরোধী দল ছিল না। মাত্র ৪ দিন সংসদ ছিল। অংশগ্রহণকারী দলের মধ্যে বিএনপি পায় ২৭৮টি (বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৮ জন), ফ্রিডম পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র ১০টি।

সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

১৯৯৬ সালের ১২ জুন এই নির্বাচন হয়। মোট ভোট পড়ে ৭৫.৬০ শতাংশ। ৮১টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে এই নির্বাচন হয়। জামানত ৫ হাজার টাকা।

দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসনে এবং জোট নিয়ে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া। তার দল বিএনপি এই নির্বাচনে আসন পায় ১১৬টি। বাকি আসনগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি, জামায়াত ইসলামী ৩টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জাসদ (রব) ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১টি করে আসন পান।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে ৫৫টি দলের বিপরীতে ১ হাজার ৯৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৭৪.৭৩ শতাংশ। প্রার্থীদের জামানত বেড়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়।

এই নির্বাচনে বিএনপি আসন পায় ১৯৩টি। আওয়ামী লীগ আসন পায় ৬২টি, জামায়াত ১৭টি, জাতীয় পার্টি (নাজিউর রহমান মঞ্জু) ৪টি, ইসলামী ঐক্যজোট ২টি, জাতীয় পার্টি (মতিন) ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১টি করে এবং স্বতন্ত্র ৬টি।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করার পর সব শর্ত পালন করে ৩৯টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রথম ছবিসহ ভোটার তালিকা অনুযায়ী ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩ জন ভোটারের মধ্যে ৭ কোটি ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৫ জন ভোটাররা ভোটদান করেন। ভোট পড়ার হার ছিল ৮৬.৩৪ শতাংশ। এই নির্বাচনের জামানত ১০ হাজার।

বাংলাদেশের এগারোটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থীর ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই উল্লেখযোগ্য আসন পায়নি।

আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসন ছিল ২৩০, বিএনপি ৩০, জাতীয় পার্টি ২৭ , জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জামায়াত ২, বিজেপি ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১টি করে এবং স্বতন্ত্র ৪টি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন

বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ১১টি দল অংশ নেয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪১ শতাংশ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে এককভাবে ২৭৩টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি পায় ১৮টি আসন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিশ দলীয় জোট, দুটি জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি পায় ৬টি আসন।

বাংলাদেশের এগারোটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থীর ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই উল্লেখযোগ্য আসন পায়নি। একবার জামায়াত ইসলামী বেশকিছু আসন পেয়েছে—তবে তাও বিএনপির কাঁধে ভর করে। তবুও নির্বাচন এলেই প্রতিবার কেন বড় রাজনৈতিক দলগুলো এসব দল যাদের ভোট ব্যাংক নেই, সাংগঠনিক তেমন শক্তি নেই তাদের নিয়ে টানা হেঁচড়া করে?

হ্যাঁ, সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা বললে, জামায়াত ঠুঁটো জগন্নাথ নয়। এমনকি এখন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও সাংগঠনিক দক্ষতায় এগিয়ে আছে। কিন্তু তাদের ভোট ব্যাংক কোথায়? মিছিল সমাবেশে অনেক লোক হয়। অনেক আসনে প্রার্থী হয় তাদের দল থেকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আসনে জয়ী হতে পারেনি তারা।

ধর্মভিত্তিক ছাড়াও আরও কিছু নাম সর্বস্ব দল আছে যাদের নিয়ে নির্বাচনের সময় বড় দলগুলো টানাটানি করে। কেন করে তারাই জানে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন এক দলীয় জোটে এমন কিছু দল আছে যারা তিনটি নির্বাচনে একটি আসনেও প্রার্থী দেয়নি। দিলেও জেতেনি। শুধু দলের সিনিয়র এক নেতা এক মেয়াদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আর তাতেই খুশি।

সদ্য বিলুপ্ত হওয়া জামায়াত ইসলামীর বিশ দলীয় জোটের অবস্থা ছিল আরও করুণ। প্রায়ই শোনা যেত অমুক দল বিশ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কখনোই জোটে দলের সংখ্যা কমেনি। মূল অংশ বের হয়ে গেলেও অণু কিংবা পরমাণু একটা অংশ থেকে গেছে। আর তাতেই বিশ দলীয় জোটের বিশ দল অক্ষুণ্ন থেকেছে সব সময়।

তবে এসব দলগুলো জোটে রেখে বড় দলগুলোর কী লাভ হয় জানা না থাকলেও ছোটরা যে গাছের তলার দুটোই কুড়াতে পারেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী