ছবি : সংগৃহীত

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্যে তফসিল ঘোষণা করেছেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর আর ভোট গ্রহণ হবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। এর মাঝখানে মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই, আপিল ও প্রত্যাহার ইত্যাদি সুযোগ হবে। নির্বাচনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা ছাড়াও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আরেকটা গুরুত্ব আছে।

তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ক্ষমতাসীন সরকার কার্যত কেবল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পরিণত হয়। সরকারের প্রশাসন, পুলিশ ইত্যাদি এরা সকলেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে আসে। পরবর্তী সরকার গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বিদ্যমান সরকার কেবল দৈনন্দিন কার্যাবলী পালন করবে। এগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এইসব আইন ও প্রথার চেয়ে এখন আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু হচ্ছে তফসিল ঘোষণার পর চলমান আন্দোলন এবং দেশের সার্বিক অবস্থার পরিণতি কী হবে।

বিএনপির নেতৃত্বে যারা যুগপৎ আন্দোলন করছে ওরা সকলেই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে কর্মসূচি নিয়েছে। সিপিবি ও বাসদের যে বাম গণতান্ত্রিক জোট, সেই জোটও তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

তফসিল ঘোষণার সাথে সাথেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীরা বোমা ফাটিয়েছে, গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে এবং বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বিএনপি এবং ওদের সহযোগীদের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি চলমান, সেই কর্মসূচির সাথে যুক্ত হয়েছে হরতাল।

বাসে আগুন দেওয়া কিন্তু থেমে নেই। পাশাপাশি টাঙ্গাইলে ঘারিন্দা রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনের তিনটি বগি পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাত তিনটার দিকে এই ঘটনা ঘটে।

এখন যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে, তা হচ্ছে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি কি তবে ২০১৪ সালের মতো আরেকটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? দেশে কি তবে সেই সময়ের মতো আবার সন্ত্রাস-সহিংসতা শুরু হবে?

এখন যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে, তা হচ্ছে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি কি তবে ২০১৪ সালের মতো আরেকটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? দেশে কি তবে সেই সময়ের মতো আবার সন্ত্রাস-সহিংসতা শুরু হবে? আওয়ামী লীগ কি তবে একতরফা নির্বাচন করে কয়েকটা প্রায়-অনুগত রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো সংসদ সাজিয়ে আবার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকতে চেষ্টা করবে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর যে যেভাবেই দেওয়ার চেষ্টা করুন, উত্তর আমরা পেয়ে যাবো কয়েকদিনের মধ্যেই। আগামী ছয়-সাত সপ্তাহে যাই-ই ঘটুক না কেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না যে দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

কার্যকর এবং স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পথের যাত্রা যেন পিছিয়ে গেলে আরও কয়েক বছর। অথচ বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চাইলেই এই অচলাবস্থা নিরসন করতে পারতো এবং গণতন্ত্রের পথে শুভ যাত্রার সূচনা করতে পারতো সবার জন্য।

বিএনপি যে ধরনের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে তা যে এই দেশে আর কার্যকর হবে না, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে যে হবে না, তা তো স্পষ্ট। ওদের প্রয়োজন ছিল চলমান আন্দোলনকে রাজনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাথে আলাপ আলোচনা করে ন্যূনতম সমাধানের পথ খুঁজে বের করে নির্বাচন যাতে গ্রহণযোগ্য হয় সেই রকম একটা ব্যবস্থা করা।

সেই রকম নির্বাচন হলে বিএনপি এবং ওদের মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হয় জিতে আসতে পারতো অথবা আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারতো। দৃশ্যতই বিএনপি এবং ওদের মিত্ররা আন্দোলনের ওপর ভরসা করার সাথে সাথে বিদেশিদের ওপরও ভরসা করছিল যে ওরা নিশ্চিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিতে পারবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, একটি সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য যে মাত্রায় গণঅভ্যুত্থান প্রয়োজন বিএনপি এবং ওদের মিত্ররা তা গড়ে তুলতে পারেনি। আর আওয়ামী লীগেরও তো একটা জনভিত্তি রয়েছে, বেশ বড় এবং শক্তিশালী ভিত্তি তা।

এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বিএনপি চাইলেও ওদের আন্দোলন ফেলে নির্বাচনে চলে আসতে পারবে না এবং ওরা তা চাইবে বলেও মনে হয় না। কেননা এখন যে নির্বাচন হবে তা যে একদম নিরপেক্ষ বা গ্রহণযোগ্য হবে সেই রকম নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারবেন না।

অপরদিকে তফসিল ঘোষণা করা এবং সেই অনুযায়ী নির্বাচনের ব্যবস্থা করা তা তো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, ওরা সেইখান থেকে সরে আসবে কীভাবে? ফলে নির্বাচনের লক্ষ নিয়ে যে যাত্রা, সেই যাত্রা শুরু হয়ে গেল কিন্তু বিএনপি না পারলো থামাতে, না পারলো সেই যাত্রায় যোগ দিতে। এখন কী করতে পারে বিএনপি ও তার মিত্ররা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো; যারা বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা পাল্টানোর আন্দোলনে আছেন?

কার্যকর এবং স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পথের যাত্রা যেন পিছিয়ে গেলে আরও কয়েক বছর। অথচ বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চাইলেই এই অচলাবস্থা নিরসন করতে পারতো এবং গণতন্ত্রের পথে শুভ যাত্রার সূচনা করতে পারতো সবার জন্য।

বিদেশিদের হস্তক্ষেপ তো কোনোভাবেই কোনো দেশের জন্যেই মর্যাদাজনক ব্যাপার নয়। তথাপি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওদের সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু যে চিঠি পাঠিয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির উদ্দেশ্যে তাকে ধরে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নিজেদের মধ্যে একটা সংলাপের সূচনা করতে পারে। লক্ষ্য করবেন, এবারের নির্বাচনী তফসিলে অনেকটা সময় রাখা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে এখনো কার্যকর আলোচনা বা সংলাপের সূচনা করতে পারে এবং নিজেদের মধ্যে তা কাজে চালিয়ে নেওয়ার মতো সমঝোতায় পৌঁছতে পারে। এটা ছাড়া সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আর কীইবা করার আছে। আগেই বলেছি, যে মাত্রায় গণঅভ্যুত্থান হলে সরকার হটানো যেত, তা তো ওরা করতে পারেনি। তাহলে আলোচনা ছাড়া আর কীইবা করার আছে।

এটা যদি ওরা না করে তাহলে ওদের আন্দোলনের কর্মসূচি চালিয়েই যেতে হবে। আর কর্মসূচির ধরন এখন যেটা হয়েছে তা তো আর জনগণের অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি নেই—এখন যেটা চলছে তা কেবল চোরাগোপ্তা হামলায় পর্যবসিত হয়েছে। এইরকম কর্মসূচিতে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে—সেইরকম ভোগান্তিও হয়তো মেনে নেওয়া যেত যদি শেষ পর্যন্ত কোনো লাভের প্রত্যাশা থাকতো। যদি দেখতাম যে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে কোনো সুফল হবে তাহলে কিছু ক্ষতি সহ্য করা যায়—এখানে তো সেই রকম কোনো সম্ভাবনাও নেই।

বিএনপি এবং অন্যান্য দলগুলোর যে কথাটা উপলব্ধি করতে হবে তা হচ্ছে যে, সরকারের পতন এখন আর সম্ভব নয়। রাজনীতিতে আপনারা যে কথাটা চালু করেছেন ‘খেলা হবে’ খেলাটা এখন মাঠে গড়িয়ে গেছে। খেলায় অংশগ্রহণ করে তবেই অ্যাম্পায়ারের নিরপেক্ষতা দাবি করতে হবে।

লক্ষ্য হচ্ছে, এমন একটা নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে একদল হেরে গেলেও যেন ফলাফল সবাই মেনে নিতে পারে। সেইটাই যদি লক্ষ্য হয় তবে সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে মাঠেই নামতে হবে।

খেলা হতে দেবো না বললে এখন আর খেলা থামবে না। খেলা হবে, হয়েই যাবে। আপনি খেলায় নামতে পারেন অথবা ওয়াকওভার দিতে পারেন। কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত।          

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট