ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রথম যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক কনভেনশনের মাধ্যমে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত যুবলীগ আজ বয়সের ভারে পূর্ণ। যুবলীগ এখন আর যুবক নেই, পরিপূর্ণ এক সংগঠন। এখন যুবলীগের কাছে জাতির চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলানোর সময় এসেছে।

সংখ্যায় যায় হোক, যুবসমাজ দেশের জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা সক্ষম, উৎপাদনশীল, দেশের জন্য কাজ করতে মুখিয়ে থাকেন সবসময়। তাই যুব সংগঠনগুলোর দায়িত্ব হলো এই যুবসমাজকে দেশের অগ্রগতিতে ঠিকমতো কাজে লাগানো।

দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে বড় সংগঠন হিসেবে আওয়ামী যুবলীগের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি দুটি—ছাত্রলীগ আর যুবলীগ। ছাত্রসমাজ শিক্ষাজীবন শেষে মূল রাজনীতিতে যাওয়ার আগে রাজনীতির আসল শিক্ষাটা পেতে পারেন যুবলীগে।

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে ছাত্রলীগ আর যুবলীগের ভূমিকা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল দল এবং সরকারের বাইরে যুবসমাজকে উৎপাদনশীলতার কাজে লাগাতেও যুবলীগ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। সেই দায়িত্ব যুবলীগ কতটা পালন করতে পেরেছে, সেই প্রশ্নটা রয়েই গেছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবার হোঁচট খেয়েছে যুবলীগ। প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৫ আগস্ট ঘাতকদের টার্গেট ছিলেন দেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত সৈনিক শেখ ফজলুল হক মনিও।

১৫ আগস্টের পরের সরকারগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার সমানতালে চলেছে যুবলীগের ওপরও। কিন্তু এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে যুবলীগ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং বাংলাদেশকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করেন। সেই সংগ্রামে তার পাশে ছিল যুবলীগ।

দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে বড় সংগঠন হিসেবে আওয়ামী যুবলীগের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি দুটি—ছাত্রলীগ আর যুবলীগ।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা নিয়ে রাজপথে ছিল যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাজপথে নেমে পুলিশের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন যুবলীগ নেতা নূর হোসেন। তার এই আত্মদান স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল। শুধু স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন নয়, সব ন্যায্য আন্দোলনে এক অফুরান অনুপ্রেরণার নাম যুবলীগ নেতা নূর হোসেন।

স্বৈরাচারের পতন হলেও গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। গণতন্ত্রের জন্য শেখ হাসিনাকে লড়তে হয়েছে আরও লম্বা সময় ধরে। সেই সময়ও যুবলীগ ছিল অতন্দ্র প্রহরী হয়ে।

দীর্ঘ পথচলায় বিভিন্ন সময়ে যুবলীগ মাঠের লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি যুবসমাজকে নিয়ে নানা বিপর্যয়ে দেশের পাশে দাঁড়িয়েছে, সাধারণ মানুষের ভরসা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে আওয়ামী লীগের লড়াই-সংগ্রামে বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানও রেখেছে যুবলীগ।

তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে অবক্ষয়কালের শুরু যুবলীগের। এটা স্বাভাবিক বিরোধী দলে থাকলে একটা সংগঠনের বিকাশ যতটা সহজ, ক্ষমতায় থাকলে ততটাই কঠিন।

‘যুবলীগ’ লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে তাদের সংগ্রামী ইতিহাসের চেয়ে অপকর্মের তালিকায় লম্বা হয়। যুবলীগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটা আসে ২০১৯ সালে….

আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। আর এই সুযোগে যুবলীগের ঢুকে পড়েছে হাইব্রিডরা। ত্যাগী নেতাকর্মীরা এখন কোণঠাসা। লোভীরা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সুবাদে যুবলীগের নাম জড়িয়ে যায় টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি, মাস্তানির সাথে।

‘যুবলীগ’ লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে তাদের সংগ্রামী ইতিহাসের চেয়ে অপকর্মের তালিকায় লম্বা হয়। যুবলীগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটা আসে ২০১৯ সালে। সরকার ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে আটকে যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকে। সেই অভিযানে আরও অনেকের সাথে পতন ঘটে তখনকার যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীরও।

প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশের নেতৃত্বে এখন চলছে যুবলীগের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। মূল সংগঠন ক্ষমতায় থাকলে একটি সংগঠনে শুদ্ধি প্রক্রিয়া চালানো অনেক কঠিন। তারচেয়ে বড় কথা যুবলীগের মতো তৃণমূলে বিস্তৃত একটি সংগঠনের ওপর কেন্দ্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ আরোপও কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের যেখানে যুবলীগ নেতাকর্মী যাই করুক, তার দায় নিতে হবে মূল নেতৃত্বকে। তাই কাজটা আরও কঠিন।

স্বচ্ছ ভাবমূর্তির শেখ পরশ দায়িত্ব নেওয়ার পর যুবলীগের অপকর্মের তালিকা ছোট হয়ে আসছে। নেতিবাচক অতীত মুছে ফেলে সংগ্রামী ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে নতুন নেতৃত্ব। করোনার দুঃসময়ে তারা মানুষের পাশে থাকার চেষ্টাও করেছে। তারপরও যে বিপুল সম্ভাবনা এবং যুবলীগের কাছে দেশ ও জনগণের যে প্রত্যাশা তার সামান্যই মেটাতে পারছেন তারা। বিপুল প্রত্যাশার বিপরীতে হতাশার জোগান দিচ্ছে যুবলীগ। তবে অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ততা কমেছে, এটাও একটা বড় উন্নতি বলা যায়।

সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কঠিন সময়। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে। এই সময়ে যুবলীগেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুস্থ রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে যুবলীগ রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। নিজেদের অতীতের গ্লানি মুছে ফেলে যাত্রা শুরু করতে উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের দিকে। যুবলীগ নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কোনদিকে যাবে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ