ছবি : সংগৃহীত

শীত শীত রাতে লেখাটা যখন লিখছি তখন হাজার মাইল দূরে ভূ-মধ্যসাগরের তীরে চলছে ইসরায়েলি বাহিনীর নজিরবিহীন নিধনযজ্ঞ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমারু বিমানগুলো মৃত্যুর দূত হয়ে গাজার আকাশে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

কামান, ড্রোন আর ট্যাংকের লক্ষ্যভেদী গোলায় একেরপর এক কংক্রিটের কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে বসত-বাড়ি, লোকালয় আর শরণার্থী শিবিরগুলো। বাদ যাচ্ছে না হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল কোনোকিছুই।

কত নিষ্পাপ শিশু, আর নর-নারীর করুণ মৃত্যুর পর ইসরায়েলের মৃত্যুক্ষুধা মিটবে তা কেউ বলতে পারছেন না। জাতিসংঘের মহাসচিব এরইমধ্যেই গাজাকে শিশুদের কবরস্থান (A graveyard for children) বলে উল্লেখ করেছেন। এক মাসের সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন দশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। 

ইসরায়েলি বাহিনীর নিধনযজ্ঞে বারবার সামনে আসছে একটি সামরিক সংগঠনের নাম। যার নাম হামাস বা Islamic Resistance Movement। ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের আক্রমণের মধ্য দিয়েই নতুন এই সংঘাতের শুরু। ওই হামলায় ১৪০০ ইসরায়েলি মারা যান। জিম্মি করা হয় অন্তত ২৫০ জন।

এই হামলার পাল্টা জবাবে এক মাস ধরে চলমান ইসরায়েলি বর্বরতা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের পরাশক্তিগুলো বলছে, হামাসের পরিপূর্ণ বিনাশের পরই কেবল যুদ্ধ বিরতি সম্ভব, তার আগে নয়। এদিকে গাজায় অগ্রসরমান ইসরায়েলি পদাতিক সেনাদের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে হামাস যোদ্ধারা। আমরা ফিরে দেখি হামাসের উৎপত্তি, বিকাশ, বর্তমান সংকট ও অর্জনের দিকগুলো।

যুদ্ধ কী? প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ রাজনীতিরই সম্প্রসারিত রূপ। অর্থাৎ অন্যায্য কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা কূটচালই যুদ্ধের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তেই আরব ভূ-খণ্ডে ইসরায়েলের জন্ম।

যে দেশটির গোড়াপত্তন হয়েছিল হাজার বছর ধরে আরব ভূমিতে বসবাস করা ফিলিস্তিনি জনগণকে বাস্তুচ্যূত করার মাধ্যমে। যাকে আরব বিশ্বে অভিহিত করা হয় নাকবা (Nakba) নামে। যার অর্থ দুর্যোগ বা মহাবিপর্যয়। ওই সময় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রায় আট লক্ষ আরব ফিলিস্তিনিকে ঘর ছাড়া করে ইসরায়েলিরা। পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় ফিলিস্তিনিদের ৬০০টিরও বেশি গ্রাম।        

সেই শুরু। এরপর ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে দুটি আরব-ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়েছে। পশ্চিমা মিত্র শক্তির সহায়তায় যুদ্ধে জয়ী হয়েই ইসরায়েল আরও আরব ভূমি দখল করেছে। পরিকল্পিতভাবে দখলকৃত ভূমিতে স্থাপন করেছে ইহুদি বসতি।

কংক্রিটের কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে বসত-বাড়ি, লোকালয় আর শরণার্থী শিবিরগুলো। বাদ যাচ্ছে না হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল কোনোকিছুই। কত নিষ্পাপ শিশু, আর নর-নারীর করুণ মৃত্যুর পর ইসরায়েলের মৃত্যুক্ষুধা মিটবে তা কেউ বলতে পারছেন না।

ক্রমাগত এই দখল আর জুলুমের প্রতিবাদে ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনে শুরু হয়েছিল প্রথম ইন্তিফাদা বা অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের মধ্যেই নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়াতে পিএলও-এর পর জন্ম হয় আরেকটি সংগঠন হামাসের।

পিএলও মধ্যপন্থী, আপসকারী হলেও জন্মলগ্ন থেকেই হামাস ছিল অতি কঠোর। সংগঠনের ঘোষিত লক্ষ্যই হলো, ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিনাশ। হামাস গঠন করেছিলেন একজন ইমাম। নাম আহমেদ ইয়াসিন।

ছোটবেলায় সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। তাই সারা জীবন তিনি চলেছেন হুইল চেয়ারে। তিনি ছিলেন মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য। পড়াশোনা করেছেন কায়রোতে। পরে শিক্ষকতা করেছেন। গাজায় মুসলিম ব্রাদারহুডের আদলেই হামাস গড়ে তোলেন। হামাস ও পিএলও উভয়ই ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের কথা বললেও তাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে।

ইয়াসির আরাফাতের পিএলও রাজনৈতিক মতাদর্শে জাতীয়তাবাদী আর হামাস ইসলামপন্থী। যদিও প্রথম ইন্তিফাদার সময় দুই পক্ষই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু প্রথম ইন্তিফাদার পরই পিএলও এবং হামাসের মধ্যে চরম মতভেদ দেখা দেয়। ইয়াসির আরাফাত পশ্চিমাদের দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাবকে সামনে রেখে ইসরায়েলের সাথে চিঠি বিনিময় এবং ১৯৯৩ সালে ওসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলে তার ঘোর বিরোধিতা করে হামাস।

শুধু গাজাবাসীই নয়, পশ্চিম তীরের অনেক বাসিন্দাও এই চুক্তির বিরোধী ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, এটি একটি ধোঁকা, ছলচাতুরী। যা পরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এমন বাস্তবতায় ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের সংসদ নির্বাচনে গাজা উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে হামাস।

পরে পিএলও-এর সদস্যদের সাথে স্বল্প সময়ের এক সংঘাত শেষে ২০০৭ সালে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় সংগঠনটি। এর আগে ২০০৪ সালে গাজা সিটিতে এক রকেট হামলায় হত্যা করা হয় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ ইয়াসিনকে। যদিও এক সময় এই আহমেদ ইয়াসিনকেই হামাস প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিল ইসরায়েল।

বর্তমানে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ইসরায়েল হামাসকে প্রধান শত্রু বললেও এক সময় তার উত্তরসূরিরাই হামাসকে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে। ১৯৭০ এর দশকে আহমেদ ইয়াসিন গাজায় যখন ইসলামি সমাজতন্ত্রের আদলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল তখন ইসরায়েল তাকে সহযোগিতা করেছে। কারণ ইসরায়েল চেয়েছিল ১৯৬৪ সালে গড়ে ওঠা পিএলও’র (Palestine Liberation Organization) একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করতে।

তারা চেয়েছিল কুখ্যাত ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের বিভক্ত করতে। মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর রন পল একবার সিনেট অধিবেশনে বলেছিলেন, হামাসকে তৈরি করেছে ইসরায়েল কারণ ইসরায়েল আরাফাতকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল।

ইয়াসির আরাফাতও ইতালির এক সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, হামাস ইসরায়েলের তৈরি। ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন একবার আরাফাতকে বলেছিলেন, হামাসকে তৈরি করা ছিল গুরুতর ভুল। এছাড়া গাজায় কাজ করা একাধিক ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা বিশ্বের অনেক গণমাধ্যমে বলেছেন, হামাসের জন্য ইসরায়েলের আলাদা বাজেট ছিল। আর হামাসকে তৈরি করা ছিল বড় ধরনের মারাত্মক ভুল।

বিপুল সংখ্যক মানুষকে বন্দিশালায় রেখে ইসরায়েল তার আরব মিত্র বাড়ানোর চেষ্টায় ছিল। কয়েকটি দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর ইসরায়েল অপেক্ষায় ছিল সৌদি আরবের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের।

ইয়াসির আরাফাতের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হামাস গড়তে সহযোগিতা করলেও খুব দ্রুত হামাস ইসরায়েলের একমাত্র শত্রুতে পরিণত হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, হামাস যোদ্ধাদের হামলায় এই পর্যন্ত যত ইসরায়েলি মারা গেছেন আরব জাতীয়তাবাদী যোদ্ধাদের সাথে ইসরায়েলের এত রক্তপাত হয়নি।

আর সেই জন্যই ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পুরো এলাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলে ইসরায়েল। বন্ধ করে দেয় বহিঃবিশ্বের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ। এতে পুরো গাজা উপত্যকা পরিণত হয় কারাগারে। মুক্ত আকাশের নিচে যেখানে বন্দি প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ।

বিপুল সংখ্যক মানুষকে বন্দিশালায় রেখে ইসরায়েল তার আরব মিত্র বাড়ানোর চেষ্টায় ছিল। কয়েকটি দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর ইসরায়েল অপেক্ষায় ছিল সৌদি আরবের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই চুক্তির বেশ অগ্রগতি হয়েছিল।

ধারণা করা হচ্ছিল কয়েক মাসের মধ্যেই ঐতিহাসিক এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। যাতে আরব বিশ্বের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হবে। তৈরি করা যাবে ইরান বিরোধী শক্তিশালী বলয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই চুক্তির সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে গেছে। ইসরায়েলের উদারপন্থী ইহুদি বুদ্ধিজীবী, লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক কলামে লিখেছেন, হামাসের এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল সৌদি আরবের সাথে শান্তি চুক্তির প্রচেষ্টাকে বানচাল করা।

সেপিয়েন্স নামের বিখ্যাত উপন্যাসের লেখক হারারি আরও উল্লেখ করেছেন, ৭ অক্টোবরের হামলা ও প্রায় ১৪০০ ইহুদিকে হত্যার জবাব হিসেবে ইসরায়েলি বাহিনী প্রবল শক্তি প্রয়োগ করবে এটাই স্বাভাবিক। যাতে নিশ্চিতভাবেই ভেস্তে যাবে ইসরায়েল আরব শান্তি প্রক্রিয়া। কার্যত হয়েছেই তাই। যাতে হামাসের বিজয় দেখছেন হারারি।

গাজার ইসরায়েলের বর্বর হামলা আর নির্মম নিধনযজ্ঞে এরইমধ্যেই ইসরায়েল প্রবল চাপে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া এরইমধ্যেই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কূটনীতিককে জেরুজালেম থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। সারা বিশ্বেই বইছে নিন্দার ঝড়। এমন বাস্তবতায় যুদ্ধের ময়দানে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে হামাস অনেকটা এগিয়ে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

তবে ৭ অক্টোবরের হামলায় নিরস্ত্র ইহুদিদের হত্যার বিষয়টিও হামাসকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। কারণ আর যাই হোক, বর্তমান যুগে যুদ্ধের নামে নিরপরাধ মুসলিম, ইহুদি বা কোনো ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যা কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাই এই বিষয়টি হামাস কীভাবে সামাল দেবে তা বড় বিষয়। যার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে হামাসের ভবিষ্যৎ ও বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা।  

রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়