ছবি : সংগৃহীত

আমরা যে সংকটে রয়েছি তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। দেশে যে বিদ্যমান সরকার রয়েছে এরা পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়—অর্থাৎ তিনটি মেয়াদ পূর্ণ করেছে। একটি রাজনৈতিক দল তিন মেয়াদে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন আছে তা তো সংকট নয়—দেশের মানুষ যদি চায় তাহলে তিন মেয়াদ বা চার মেয়াদে কোনো একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকতেই পারে। কিন্তু জনগণের সামনে সেই সুযোগটা থাকছে না যে ওরা চাইলেই নির্বাচনে ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। 

সংকট হচ্ছে যে এই তিনটি মেয়াদের মধ্যে প্রথম মেয়াদ ছাড়া বাকি দুই সময়ে কোনো স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল না। ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে জাতীয় পার্টি ছাড়া বিএনপি বা অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি আর ২০১৮ সালে বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে বৃহৎ একটি জোট করে অংশ নিলেও নির্বাচনটি সাধারণভাবে নিরপেক্ষ হয়েছে বলে মানুষ মনে করে না।

ফলে এখন বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে সরকারের এই মেয়াদ শেষে যে নির্বাচনটি হবে তাও গ্রহণযোগ্য হবে না। এই ধারণা থেকে আওয়ামী লীগ জোট এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকি প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বর্তমান সরকার ভালো কাজ করেছে কি মন্দ কাজ করেছে বা ওদের জনপ্রিয়তা আছে কি নেই সেই আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি স্থায়ী থাকে তাহলে মানুষ ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারে বা আওয়ামী লীগকেই আবার ক্ষমতায় রাখতে পারে। আওয়ামী লীগ এবং ওদের জোটের অংশীদাররা ছাড়া বাকি সব দলই মনে করে যে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।

দৃশ্যত এইরকম মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। এইদিকে আওয়ামী লীগ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেটা ২০০৬ সালের আগে বিদ্যমান ছিল সেই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই—সারা দুনিয়ায় যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের বর্তমান সংবিধানের আওতায় সেইভাবেই নির্বাচন হবে—কেউ সেই নির্বাচনে অংশ নিতে এলো কি এলো না তা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

সংকটটা হচ্ছে এখানেই। যেনতেন প্রকারে একটা নির্বাচন যদি হয়ও, সেই নির্বাচনে যদি দেশের বড় দুই দলের এক দল অংশ না নেয় তাহলে তো জনগণ আর ওদের নিজেদের পছন্দমতো দলকে বা প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে না। এর মানে হচ্ছে, উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন ভালো কাজ কি মন্দ কাজ তার কোনোকিছুই জনগণ পছন্দ করছে কি করছে না, অনুমোদন করবে কি করবে না তার কোনো সুযোগ থাকল না।

...দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি স্থায়ী থাকে তাহলে মানুষ ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারে বা আওয়ামী লীগকেই আবার ক্ষমতায় রাখতে পারে।

উত্তরণ কীভাবে হবে? এই সংকট থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ নেই? নিশ্চয়ই আছে। নানাভাবেই আমরা এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারি- কোনো অভিনব পথও থাকতে পারে যেটা এখন আমাদের কারও মাথায় আসছে না। তবে সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক পথে যেকোনো রাষ্ট্রীয় সংকট থেকে মুক্তির উপায় তো দুইটা—একটা হচ্ছে গণ আন্দোলন আর আরেকটা হচ্ছে নির্বাচন।

আরেকটা পথের কথা অনেকে বলে, মিলিটারি ক্যু বা বেসামরিক কোনো ক্যুএর মাধ্যমে একটি অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে ওদের নেতৃত্বে একটা নির্বাচন করে তারপর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করা। এই যে তৃতীয় পথ, এটা তো গণতান্ত্রিক নয়ই, এই পথে গিয়ে গণতন্ত্রের পথেও যাওয়া যায় না।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সরকার থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমান ও এরশাদের অধীনে বাংলাদেশ এইরকম সামরিক শাসনের অধীনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ২০০৬ সালের পর একটা সামরিক বেসামরিক মিশেল দেওয়া বিচিত্র সরকারের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। এইগুলো কোনো সমাধানের পথ নয়।

যে দুইটা গণতান্ত্রিক পথের কথা আমরা বলছি—গণ অভ্যুত্থান ও নির্বাচন, এর মধ্যে গণ অভ্যুত্থানের চেষ্টা শুরু হয়েছে অনেকদিন ধরে এবং সেই আন্দোলন এখনো চলছে। এর মধ্যে আন্দোলনে সংঘাত, সংঘর্ষও হয়েছে, পুলিশ প্রাণ দিয়েছে, আন্দোলনকারী প্রাণ দিয়েছে, সাংবাদিকরা প্রহৃত হয়েছে আন্দোলনকারীদের হাতে।

২৮ অক্টোবর হরতাল এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াত তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। এই কর্মসূচিতে গাড়ী পুড়েছে, অ্যাম্বুলেন্স পুড়েছে, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, দেশের সব স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। ৫ এবং ৬ নভেম্বর তারা আবার অবরোধ ডেকেছে।

আন্দোলনে মানুষের মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতি সবকিছুই মেনে নেওয়া যায় যদি মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা থাকে যে আন্দোলন আমাদের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসবে, আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবো। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে বাংলাদেশের মানুষ অতীতেও ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। কিন্তু এখনকার যে চলমান আন্দোলন তাতে বিএনপি এবং জামায়াত কর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুব উল্লেখযোগ্য নয়।

এই দেশের অতীতে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেখা গেছে যে ছাত্রদের বিপুল অংশগ্রহণ থাকে, এইবারের আন্দোলনে ছাত্রদের বা তরুণদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা ছাড়াও শ্রমজীবী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এইবারের আন্দোলনে সম্মিলিতভাবে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এমনকি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আন্দোলনে তরুণদের অনুপস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতেও দেখা গেছে।

বর্তমান আন্দোলনের এটা একটা বৈশিষ্ট্য—ছাত্র-তরুণরা অনুপস্থিত, শ্রমজীবী মানুষ অনুপস্থিত। সাধারণ কর্মজীবী ও পেশাজীবী মধ্যবিত্ত নাগরিকরা কি বিএনপির আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে? কিছু মানুষ তো অংশ নিচ্ছেই—কিন্তু তারা মূলত বিএনপির এবং জামায়াতের কর্মী সমর্থক।

বিএনপি বড় দল, নিজেদের কর্মী সমর্থক রয়েছে ওদের বিপুল। কেবল দলীয় কর্মীদের নিয়েই তারা ঢাকায় বা দেশের সর্বত্র বিশাল বিশাল সমাবেশ করতে পারবে। কিন্তু গণ আন্দোলনের যে চরিত্র—মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তা বিএনপি এবং ওদের মিত্ররা এখনো অর্জন করতে পারেনি।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার বা ভোটাধিকার আদায়ের মতো জনপ্রিয় দাবি নিয়েও এরা সাধারণ মানুষকে তাদের আন্দোলনে যুক্ত করতে পারেনি। দেশে দ্রব্যমূল্যের দাম সীমাহীনভাবে বেড়েছে, আরও অনেক সংকট আছে, সেইসব কোনোকিছুই মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করতে পারছে না। আন্দোলনটা এখনো গণ আন্দোলনে রূপ নেয়নি এবং সেই রকম কোনো আশু সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

এবারের আন্দোলনের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং আরও কিছু দূতাবাসের ভূমিকা। স্পষ্টতই বিএনপি বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং সাধারণভাবে বিদেশি শক্তিগুলোর সমর্থনের ওপর বিপুল আস্থা স্থাপন করে বসে আছে। বিএনপির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা মেজর শাহজাহান ওমর তো প্রকাশ্য সভায় আনুষ্ঠানিকভাবেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবতার, রক্ষাকর্তা ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেছেন। কথাগুলো একদম যে কথার কথা নয় বা হাস্যরসের কথা নয় তা তো স্পষ্ট।

যে জিনিসটা বিএনপি এবং তার মিত্রদের আন্দোলনে অনুপস্থিত তা হচ্ছে এমন কোনো ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বা পরিকল্পনা যেটা মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে। আওয়ামী লীগের সব সীমাবদ্ধতা, স্বৈরাচারী আচরণ, মানুষের কণ্ঠরোধ করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এই সবকিছুর বিপরীতে বিএনপি ও তার মিত্ররা এমন কোনো কিছু মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি যা থেকে মানুষ মনে করতে পারে যে আওয়ামী লীগকে সরানোর জন্যে আন্দোলন করা প্রয়োজন।

ওরা এখন এক দফার আন্দোলনে রয়েছে, এর আগে ৩১ দফা নামক একটা ইলিউসিভ ধরনের অনির্দিষ্ট ও ভাসা ভাসা বালখিল্য ধরনের কর্মসূচি উপস্থাপন করেছে—তা কোনো মহলেই খুব একটা আলোড়ন তুলতে পারেনি। সেই সাথে রয়েছে আন্দোলনের মূল দল বিএনপির ওপর মানুষের আস্থার অভাব।

২৮ অক্টোবর হরতাল এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াত তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। ৫ এবং ৬ নভেম্বর তারা আবার অবরোধ ডেকেছে।

বিএনপির নেতৃত্বে বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি এবং তার পুত্র তারেক রহমানের বিদেশ থেকে বার্তা পাঠানো নিয়ে নানা কথা আছে। তারেক রহমান দলের মধ্যেও কখনো খুব জনপ্রিয় ছিলেন না, এখনো তিনি মানুষের কাছে নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।   

সবকিছু মিলিয়ে এখন যে আন্দোলনটা বিএনপি-জামায়াত চালিয়ে যাচ্ছেন তা যে গণ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করবে বা গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হবে সেই রকম কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হবে কী করে?

একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন তো দরকার যে নির্বাচনে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে এবং যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে। একটা যথাযথ নির্বাচন গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে প্রথম প্রয়োজনীয়তা। এটা কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি আন্দোলনের সহিংসতার নিন্দা করার সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এটা একটা উত্তম পন্থা হতে পারে। মূল যে দুই রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি খোলা মন নিয়ে পরস্পরের সাথে আলোচনায় বসতে পারে তবে সম্ভবত একত্ব বা সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেইরকম আলোচনা হতে হবে খোলা মন নিয়ে—অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে যাবোই না এইরকম কোনো শর্ত সামনে রেখে যদি বিএনপি আলোচনায় বসে, তবে সেই আলোচনায় কোনো ফলাফল হবে না।

দুই পক্ষের আলোচনায় একটা সমাধান বের হয়ে আসতেও পারে। আর তা যদি নাও হয়, তথাপি রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার বিষয়গুলো সামনের নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারে এবং সেইসব ইস্যুর ওপর জনগণের মতামত চাইতে পারে। আন্দোলনের পথ তাতে বন্ধ হয়ে যায় না—নির্বাচনে কারচুপি হলে সেই কারচুপির বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তোলা যায়।

আমাদের ইতিহাসে বৈরী পরিবেশে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদাহরণ তো অনেক আছে—যে রকম নির্বাচনে মানুষের রায় না মানলে যে মানুষ কী করতে পারে ১৯৭১ সবচেয়ে বড় উদাহরণ! এই পথে যদি রাজনৈতিক দলগুলো না যায় তাহলে আর কোনো সমাধান তো নেই—একজন রাষ্ট্রদূত বা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ওরা যতই আপনাকে সমর্থন করুক বা ক্ষমতায় আপনাকে দেখতে চায়, নির্বাচন ছাড়া ওরা আপনাকে কীভাবে ক্ষমতায় বসাবে। সেই পথ তো গণতন্ত্রের পথ হবে না—জনগণের পথ তো নয়ই।        

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট