১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। ক্ষমতার মসনদে খন্দকার মোশতাকের পুতুল সরকার। বঙ্গভবনে তখনো কতিপয় জেনারেল, যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। ঠিক তখন জেলখানার ভেতরে খুন হয়ে গেলেন দেশের চারজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ।

দেশের মানুষ যাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা বলে। কিন্তু কেন খুন হলেন জাতীয় নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ এবং ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী। 

এত বছরেও এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। যদিও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু আদালতে কি সব উঠে আসে? আদালত বিচার করেন সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।

মামলা যেভাবে সাজানো হয়, দুই পক্ষের আইনজীবীরা যেসব দালিলিক প্রমাণ এবং সাক্ষী সাবুদ আদালতে হাজির করেন, তার ভিত্তিতে হয় বিচার কাজ। কিন্তু ইতিহাসের সব বাঁকে কি আলো পড়ে তাতে? কিছু বিষয় এবং প্রেক্ষাপট তুলে আনা, রহস্যের পেছনের রহস্য খুঁজে বের করা আদালতের কাজ নয়।

জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবেই আসে ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার ভগ্নিপতি পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে বাকশালের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি।

অভ্যুত্থানকারীদের টার্গেট ছিল একটি পরিবার। এই পরিবারকে হত্যা করতে পারলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে তারা মনে করেছিলেন।

বোঝা যায়, অভ্যুত্থানকারীদের টার্গেট ছিল একটি পরিবার। এই পরিবারকে হত্যা করতে পারলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে তারা মনে করেছিলেন। আমরা বলি ‘কতিপয় বিপথগামী সেনারা’ হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

তৎকালীন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা কি এই বিষয়ে অবগত ছিলেন না? যাদের বিপথগামী সেনা হচ্ছে তাদের একটা অংশ ছিল তখন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত। তো কিছু চাকরিচ্যুত আর কিছু কর্মরত মাঝারি পদের সেনা কর্মকর্তা মিলে বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়সম নেতাকে সপরিবারে হত্যা করে ফেললো! বিষয়টা এতই সরল? আমার কাছে তা মনে হয় না।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের এই চার শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হলেন ২৩ আগস্ট। ততক্ষণে ক্ষমতার মসনদে খন্দকার মোশতাক। যার মন্ত্রিসভার সব সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগ তথা বাকশালের। এটা ছিল একটা আধা সামরিক সরকার। এর ওপর ছড়ি ঘোরাতো অভ্যুত্থানকারী মেজর-ক্যাপ্টেনরা।

ক্যান্টনমেন্টের সেনা নেতৃত্ব একে সমর্থন দিলেও বঙ্গভবনের ওপর তাদের পুরো কর্তৃত্ব ছিল না। যদিও বঙ্গভবন পাহারার দায়িত্বে ছিল ৪৬ ব্রিগেডের দুটি কোম্পানি, যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। তার অধীনে মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ তাকে খুব একটা মান্য করতেন না বলে তিনি মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।

১৫ আগস্টের আট দিন পর ২৩ আগস্ট গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত জাতীয় চার নেতার দৃশ্যত কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। অর্থাৎ তারা খন্দকার মোশতাকের পুতুল সরকারে যোগ দেননি। তাদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কোনোভাবেই টলানো যায়নি তাদের। চার নেতা মোশতাক সরকারকে সমর্থন দেয়নি। তখন আওয়ামী লীগও ছিল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়।

২৪ আগস্ট কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে নতুন সেনাপ্রধান করা হয়। সিজিএস খালেদ মোশাররফ আগের পদেই বহাল থাকেন। ১৫ আগস্ট নিয়ে তাদের কোনো আহাজারির সংবাদ জানা যায় না। হিসাব কি মিলছে? ২৩ আগস্ট গ্রেফতার হলেন জাতীয় চার নেতা। আর ২৪ আগস্ট সেনা প্রধানের চেয়ারে আসলেন কে?

আসলে জাতীয় চার নেতাকে সবাই হুমকি ভাবছিলেন। জাতীয় চার নেতা বেঁচে থাকলে আওয়ামী লীগ যে আবার স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে না—সেই নিশ্চয়তা তো ছিল না। সুতরাং আওয়ামী লীগ নিয়ে যেন আর ঝুঁকিই না থাকে, তা নিশ্চিত করতে জেলের ভেতর মেরে ফেলা হলো জাতীয় চার নেতাকে। কী নৃশংস ও ভয়াবহ পরিকল্পনা তাদের!

জাতীয় চার নেতার স্বজনরা দোয়েল চত্বরের কাছে তিন নেতার মাজারের পাশে কবর খোঁড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাও ভন্ডুল করে দেয় খন্দকার মোশতাক আর সহযোগীরা।

খন্দকার মোশতাক ছিলেন খুবই চতুর এবং ঠান্ডা মাথার লোক। তিনি কালক্ষেপণ করছিলেন। তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন দুইজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে—তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী এবং চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। তাদের উপস্থিতিতে একটা আপস-মীমাংসা হয়।

১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের কুশীলবেরা ৩ নভেম্বর রাতে নিরাপদে দেশত্যাগ করেন। ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর দুটি অভ্যুত্থানের কুশীলবেরা ছিলেন পরস্পরের দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহযোদ্ধা এবং প্রতিবেশী। মোশতাক দুইপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেছিলেন। দুইপক্ষকেই আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। কিন্তু এতকিছু করেও তার শেষ রক্ষা হয়নি।

৫ নভেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন খন্দকার মোশতাক। রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা। সংবিধানে তাই বলা আছে। কিন্তু খালেদ মোশাররফরা স্পিকারকে না ডেকে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করলেন।

১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের কুশীলবেরা ৩ নভেম্বর রাতে নিরাপদে দেশত্যাগ করেন। ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর দুটি অভ্যুত্থানের কুশীলবেরা ছিলেন পরস্পরের দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহযোদ্ধা এবং প্রতিবেশী।

সায়েমকে দিয়ে তারা দুটি কাজ করিয়ে নেন। এক. জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করেন। দুই. বিচারপতি সায়েম হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তিন বাহিনীর প্রধানকে বানানো হয় উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।

পাকিস্তান আমলের আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের পর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সামরিক আইন প্রশাসকের পদ তৈরি হয়! তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফরা ক্ষমতার স্বাদ তো পেয়ে গিয়েছিলেন। তবুও কেন জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো? কারা কলকাঠি নেড়েছিলেন এর পেছনে?

আরও একটা প্রশ্ন আছে। জেলহত্যার আশঙ্কা বা পরিকল্পনার কথা কি খালেদ-শাফায়াতরা কিছুই জানতেন না। টের পাননি একেবারেই? সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের দুটি গ্রুপের একটি ১৫ আগস্টে এবং অন্যটি ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কও ছিল ভালো।

জেলহত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা খন্দকার মোশতাক অবশ্যই ছিলেন। কিন্তু যাদের কথায় মোশতাক উঠবস করতেন তাদের মধ্যে কে বা করা এই নির্মম কাণ্ডটি ঘটাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে? শুধু যারা জেলাখানার ভেতরে গিয়ে জাতীয় চার নেতাদের গুলি করেছিলেন তারা ছাড়াও পেছনে অবশ্যই বড় কোনো শক্তি ছিল! ইতিহাসের এই জায়গায় আলো ফেলতেই হবে।

এখন প্রতি বছর ৩ নভেম্বর এলে আমরা জাতীয় চার নেতাদের স্মরণ করি শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। বাংলাদেশ আজীবন তা করে যাবে। কিন্তু আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও ইতিহাসের অজানা কিছু অধ্যায় আমাদের জানাটা খুবই জরুরি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের পেছনের কারিগর কারা ছিলেন। তা নিশ্চয়ই একদিন বের হবে।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী