ছবি : সংগৃহীত

ভোটাধিকার, গণতন্ত্র নিয়েই এখন কথা হচ্ছে বেশি। তাই সভা-সমাবেশ, হরতাল, অবরোধ, নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী তৎপরতা, এসব বিষয় নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির দৃশ্যমান তৎপরতাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর মধ্যে থেমে নেই সরকারের উন্নয়ন(!) প্রকল্পের উদ্বোধন। সব জায়গায় কাজ সমাপ্ত না করতে পারলেও দ্রুত উদ্বোধনে ব্যস্ত শাসকরা। এরই মধ্যে পণ্যের দামে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবন। মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। এসব কথা সামনে আসার ফুসরত কই?

দেশে অনেক কিছুই হচ্ছে। অথচ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। গার্মেন্টসের আয়ের গল্প বড় হয়ে আসে সর্বত্র। জীবনযাত্রার দুর্বিষহ অবস্থা হলেও ৫ বছরে তাদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়নি।

তাদের ন্যূনতম মজুরি ৫ বছর আগে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল ৮০০০ টাকা। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি বরাবর থেকেছে উপেক্ষিত। তারপরও মজুরি কমিশন গঠন হয়। ঐ কমিশন বিভিন্ন কৌশলে সময়ক্ষেপণ করেছে। মালিক পক্ষ ৫ বছর পর প্রস্তাব করলো এখন মজুরি দিতে পারবে ১০৪০০ টাকা।

বাহ্! এই ক’বছরে প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি ধরলেই তো মজুরি আরও বেশি হয়। এই ক’বছরে মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করলে এবং ডলারের দাম বৃদ্ধি বিবেচনা করলে তো আরও অনেক বেশি হয়।

সংখ্যাগত তত্ত্বে না গেলাম। শ্রম দিয়ে যারা কাজ করছেন, ঐসব শ্রমিকের জীবন চলছে না। আর প্রস্তাবিত মজুরিতেও চলবে না—এটা শ্রমিকসহ সচেতন মানুষ জানেন। শ্রমিকরা এও জানেন, একটু এদিক সেদিক করে, আরও একটু বাড়িয়ে ঐ মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এসব নিয়ে যেন শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠ সোচ্চারিত না হয়, তার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করা হবে।

সব গার্মেন্টস কারখানার নিয়মতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে হয়তো এই আন্দোলন অন্যভাবে সামনে আসতো। সেই পথও প্রকারান্তরে রুদ্ধ করা হয়েছে।

তাই তো নিজের বাঁচার তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব শ্রমজীবী মানুষ রাজপথে নেমেছেন। সব গার্মেন্টস কারখানার নিয়মতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে হয়তো এই আন্দোলন অন্যভাবে সামনে আসতো। সেই পথও প্রকারান্তরে রুদ্ধ করা হয়েছে। এই সময় ধৈর্য ধরে শ্রমিকদের সাথে কথা না বলে, শাসকরা এই আন্দোলনে দমন-পীড়ন এমনকি স্থানীয় দলীয় মাস্তান বাহিনী নামিয়ে এই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে। শ্রমিক হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে।

বর্তমান রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে এসব ঘটনা পুরো পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া একজন শ্রমিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো—‘আমি ১১ বছর ধরে মেশিন অপারেটার হিসেবে কাজ করছি। বর্তমানে আমার বেতন ১০ হাজার ৭০০ টাকা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করি।

আমার দুই সন্তানকে ঘরে রেখে কাজে আসি। এই টাকায় আমার ১৫ দিনও চলে না। বেতন বাড়াতে না পারেন, বাসস্থান দেন, রেশন দেন, ঐ টাকার মধ্যে খাবার কিনে দেন, শিক্ষা, চিকিৎসা দেন। বাপ মাকে টাকা পাঠানো আর সঞ্চয় এর কথা তো বাদ দিলাম। এসব না হলে বাঁচবো কেমনে, কাজ করবো কেমনে? শরীরে শক্তি না থাকলে কাজেও মন বসে না।’

এখানে তো কোনো অযৌক্তিক, বাড়তি কথা শুনলাম না। এখনকার প্রেক্ষাপটে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এই প্রস্তাব তুলে ধরতে অর্থনীতির নানা সূচক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব সূচকে ২০২২ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকের লিভিং ওয়েজ প্রতি মাসে ন্যূনতম ২৩,২৫৪ টাকা হওয়ার কথা বলা হয়েছিল (আনবার রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর তথ্যে বলা হচ্ছে)।

বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করে সমন্বয় করলে এই টাকার পরিমাণ আরও বেশি হওয়া যৌক্তিক। বাস্তবতা ও অন্য মেথডে হিসাব করলে এই টাকার পরিমাণ আরও বেশি হবে।

অতীত অভিজ্ঞতা হলো, আন্দোলন ছাড়া পথ নেই। না হলে ছলে বলে কৌশলে একটা টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে জানানো হবে এবং তা নিয়ে যাতে কথা না হয় তার জন্য নানা পথ অবলম্বন করা হবে।

আমরা শিল্প ও শ্রমিক রক্ষা করতে চাই। এসব বিবেচনা থেকে উল্লেখিত মজুরিই (২৩০০০ টাকা) গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এর সাথে শ্রমিকদের অন্যান্য দাবি যৌক্তিকতার সাথে বিবেচনা করতে হবে।

এই মজুরি শুধু শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্যই নয়, তাকে সুস্থ রেখে তার শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্যও প্রয়োজন। অতীত অভিজ্ঞতা হলো, আন্দোলন ছাড়া পথ নেই। না হলে ছলে বলে কৌশলে একটা টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে জানানো হবে এবং তা নিয়ে যাতে কথা না হয় তার জন্য নানা পথ অবলম্বন করা হবে।

তাই নিজ ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে তারা রাজপথে। এই শিল্প-শ্রমিক রক্ষার জন্য নিয়মিত উৎপাদন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। জাতীয় অর্থনীতি সচল রাখতে আরও ভূমিকা রাখবে এটাই সবার প্রত্যাশা।

আমরা চাই, আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত যুক্তিসঙ্গত ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হবে। এটি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বর্তমান সংকটের সুরাহা করতে হবে। একই সাথে শ্রমিকের জন্য বাসস্থান, রেশনিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ট্রেড ইউনিয়ন, অধিকার, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিসহ জীবনমানের পরিকল্পিত উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়ে শ্রমিকের অধিকার ও মানবিক জীবনযাপনের অধিকার দেওয়ার কাজটিও করতে হবে।

এগুলো শ্রমিক হিসেবে তার অধিকার, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বিবেচনায় মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তার ন্যায্য পাওনা। এসব না হলে অসন্তোষ দূর হবে না। শিল্প ও শ্রমিক রক্ষায় সবাই দায়িত্বশীল হবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

রুহিন হোসেন প্রিন্স ।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
hossainprince@yahoo.com