জনগণ ছাড়া আন্তর্জাতিক সমর্থন কতটা কার্যকর?
উত্তেজনাপূর্ণ ও অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতারা খুব কঠিন সময় পার করেছে। আশাবাদ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত তাদের চলমান আন্দোলন এখন ছটফট করছে বলে মনে হচ্ছে।
তাদের আন্দোলন প্রত্যাশিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপি নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান হতাশার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। তাদের অনুসারীদের উৎসাহিত ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাখার প্রয়াসে নেতৃত্ব দলের ওপর স্থির হওয়া আপাত সর্বনাশ সত্ত্বেও উসকানিমূলক বক্তব্য উপস্থাপন করে চলেছে।
বিজ্ঞাপন
বিএনপির কৌশলের এই স্পষ্ট দ্বন্দ্বে তাদের প্রচারণা কতটা সত্যিকার অর্থে সফল হবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। দলের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা অনুভব করছে যে রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা সঠিক দিকে যাচ্ছে না। ফলে, তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশার বোধ জন্ম নিয়েছে। অন্যদিকে, উসকানিমূলক বক্তৃতার মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব তাদের অনুসারীদের উত্সাহী রাখার জন্য চেষ্টা করে চলেছে।
আরও পড়ুন
এই আন্দোলনের বৃহত্তর চিত্র, যাকে সাধারণত ‘মহাসমাবেশ (গ্র্যান্ড র্যালি)’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে তা একটি কঠোর বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে কারণ এইসব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ এবং আবেগের লক্ষণীয়ভাবে ঘাটতি রয়েছে।
যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি নাগরিকরা বিএনপির মহাসমাবেশ বা অন্যান্য নীতিকে পাত্তা দিচ্ছে না। সাধারণ জনগণ এই ধরনের আন্দোলনে সমর্থন প্রদানের পরিবর্তে ক্রমশ সতর্ক হয়ে উঠছে। বিএনপির এই প্রচেষ্টা দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে বলে তারা উদ্বিগ্ন।
বিএনপি সাংগঠনিকভাবে জটিল সমস্যার মোকাবিলা করছে কারণ তাদের আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণের অভাব রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য জনগণের সমাবেশ এবং ব্যাপক সমর্থন অর্জনের ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের সুফল নিজেদের পক্ষে আনার জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। সুতরাং, দল এবং জনগণের মধ্যে দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির আন্দোলন সফল করার জন্য।
যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি নাগরিকরা বিএনপির মহাসমাবেশ বা অন্যান্য নীতিকে পাত্তা দিচ্ছে না। সাধারণ জনগণ এই ধরনের আন্দোলনে সমর্থন প্রদানের পরিবর্তে ক্রমশ সতর্ক হয়ে উঠছে।
বিএনপির আন্দোলনের প্রতি জনগণের অসন্তোষের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তারা যেভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে তাতে তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে এই জন্য তারা যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চলেছে তাতে দেশে রাজনৈতিক সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে।
জনগণ বিএনপির কর্মসূচিকে সমর্থন করছে না কারণ ১৫ বছরে তারা দেশের জনগণের সামনে এমন কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারেনি যা তাদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। ফলে, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সক্ষমতার ওপর তাদের আর বিশ্বাস নেই।
জনগণের সমর্থন না পেয়ে বিএনপি কৌশল বদল করে তাদের মিত্র পিটার হাস এবং আমেরিকার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে এই দলটি রাজনৈতিকভাবে সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে কারণ তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের পরিবর্তে বিদেশি সমর্থনের ওপর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এই ধরনের কৌশল জনগণের মধ্যে বিএনপি সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে এই জন্য যে বিএনপি নেতৃবৃন্দ কতটা বোকা হলে দেশের জনগণের ওপর নির্ভর না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশি বন্ধুদের ওপর নির্ভর করে আত্মবিশ্বাসের সাথে সময় অতিক্রম করছে।
বাইরের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। এটি সমস্যায় থাকা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য আশার সঞ্চার করতে পারে। তবে, কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশি বন্ধুদের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা দেশীয় রাজনীতি বিদেশি স্বার্থ থেকে কতটা স্বাধীন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
কৌশলের এই পরিবর্তনে বিদেশি সম্প্রদায় এবং বিএনপির মূল সমর্থকরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে সেই দিকে দেশের জনগণ তাকিয়ে আছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের রাজনীতির জটিল সমীকরণের কারণে বিএনপি বর্তমানে একটি কঠিন অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিবাদ, ধর্মঘট এবং এমনকি রক্তপাত দেশের রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদা তাদের লক্ষ্যগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে।
বিএনপির ইতিহাস সাফল্য-ব্যর্থতার পর্যায়ক্রমে জর্জরিত। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে সামরিক শাসক দ্বারা জন্মলাভ করা এই দলটি কখনো ক্ষমতায় ছিল, আবার কখনো বিরোধী দলে ছিল। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে বিএনপি নতুন করে বিপাকে পড়েছে। ফলে, তাদের উচিত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করা।
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির শীর্ষ নেতারা ভালোভাবেই জানেন যে তাদের দাবি আদায় করা কতটা কঠিন। দলের উচ্চপদস্থ নেতারা হতাশাগ্রস্ত কারণ তারা বুঝতে পেরেছেন যে বর্তমান আন্দোলন ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে, এই অবস্থায় তারা কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির পথ পরিক্রমায় সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তা দেখার বিষয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দলের মূল মিশন হলো কর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য বিতর্কিত বক্তৃতার ওপর নির্ভর করা। বিএনপি নেতাদের ক্ষুব্ধ বক্তব্যের ফলে দলের কিছু সমর্থকরা হয়তো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বর্তমান সরকার পদত্যাগ করবে তাদের দাবির মুখে। সরকার পতনের আন্দোলনে সফলতা অর্জন করা একটি জটিল কাজ কারণ এই ধরনের আন্দোলনে দেশের আপামর জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়।
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের লক্ষ্য দলের শক্তি প্রদর্শন এবং সমর্থকদের একত্রিত করা। কিন্তু তাদের আন্দোলনে সাধারণ জনগণের অনাগ্রহ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য উদ্বেগের বিষয়। সফল রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে হলে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছাড়া বিএনপির পক্ষে তাদের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
জনগণ বিএনপির কর্মসূচিকে সমর্থন করছে না কারণ ১৫ বছরে তারা দেশের জনগণের সামনে এমন কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারেনি যা তাদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।
বর্তমান রাজনৈতিক আবহে জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ জন্ম নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইতিহাস বাংলাদেশে রয়েছে। ২০১৩-১৪ সালের সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণ পুনরায় প্রত্যক্ষ করতে চায় না।
দেশের বেশিরভাগ নাগরিক সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ফলে, বিএনপির কাজ হচ্ছে সহিংসতার পথ পরিবর্তন করে জনগণের আস্থা অর্জন করা। তাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন সম্ভব, অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় নয়।
আরও পড়ুন
রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে বিএনপির হতাশা পিটার হাস ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের নির্ভরতা বাড়িয়েছে। জনগণের আস্থা অর্জনে চেষ্টা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশি বন্ধুদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। এই ধরনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির নেতিবাচক চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।
ফলে, এই ধরনের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মাধ্যমে বিএনপিকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিনগুলোয়। বিরোধীদের আন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে চাপা অস্বস্তি থাকলেও নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করার মাধ্যমে এক ধরনের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে অল্প সময়ের মধ্যেই সরকার পতনের আন্দোলন সফল হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো জনসম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হয় না।
তাছাড়া, বাংলাদেশের বর্তমান যে অবস্থা সেইখানে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়া অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে আগামী নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং জনগণের সামনে এমন একটি ইশতেহার উপস্থাপন করা যাতে জনগণ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক