ছবি : সংগৃহীত

গল্পের ছলে বা সৎ-অসৎ উদ্দেশ্যে সমাজে মিথ্যা, অর্ধসত্য ও কাল্পনিক তথ্যের বিস্তার নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যুদ্ধ, সংঘাত, অতিমারি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় মিথ্যা (Lies), গুজব (Rumours), ভুলতথ্য (Misinformation), অপতথ্য (Disinformation), অর্ধসত্য (Half-truth), প্রচারণাভিত্তিক (Propaganda) তথ্য বেশ দ্রুত ছড়ায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য ছয় গুণ বেশি দ্রুত ছড়ায়। সারাবিশ্বে তথ্য, যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ ও নতুন নতুন যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের আবিষ্কারের ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের যোগাযোগ প্রক্রিয়া এখন অনেক সহজ। ৮০-এর দশকে প্রখ্যাত যোগাযোগ তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহান (Marshall McLuhan) যে বিশ্ব গ্রামের (Global village) কথা বলেছিলেন তা আজ প্রকৃতপক্ষেই মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। যার প্রধান নিয়ামক স্মার্ট ফোন।

ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে ঠিক তেমনি বাড়িয়েছে নতুন নতুন ঝুঁকি। এতে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, অনেক সময় সংঘাত, সহিংসতায় ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের অতি প্রবাহ বা অত্যধিক শেয়ারিং এর বিষয়টিকে ইউনেসকো উল্লেখ করছে তথ্য বৈকল্য (Information Disorder) হিসেবে। গণযোগাযোগ তাত্ত্বিকরা যে বিষয়টি মোকাবিলার জন্য জোর দিচ্ছেন যাচাইকরণ বা Fact checking এর ওপর।

বর্তমান বিশ্বে প্রকৃতপক্ষে মানুষের দুইটি জগতে বাস। একাডেমিক ভাষায় যার একটি হলো আমাদের সামনের প্রকৃত দুনিয়া (Actual World) আরকেটি হলো ভার্চুয়াল দুনিয়া (Virtual word)। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত Hootsuite ও We Are Social নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের ‘The Digital 2022 Global Overview Report’ এ বলা হয়েছে পৃথিবীতে প্রায় ৪৬২ কোটি মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে যুক্ত, যারা গড়ে প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে এই হার দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ ও স্মার্ট ফোনের ব্যবহার বেড়ে গেছে। ২০১৭ সালের এক গবেষণার তথ্যে জানা যায়, ঢাকা হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেসবুক নগরী। তখন ঢাকাতে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লক্ষ। 

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে মিথ্যা উসকানিমূলক তথ্য (ছবি, ভিডিওসহ) ছড়িয়ে পড়ায় এরইমধ্যে ভয়াবহ সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

এই তালিকায় প্রথম ছিল ব্যাংকক। যে শহরে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি। ২০২৩ সালে এসে সংখ্যা যে আরও বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে মিথ্যা উসকানিমূলক তথ্য (ছবি, ভিডিওসহ) ছড়িয়ে পড়ায় এরইমধ্যে ভয়াবহ সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। যাচাইকরণ ছাড়া এই তথ্যগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে অবনতি হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির। ঘটেছে প্রাণহানিসহ ধ্বংসাত্মক সব ঘটনা।

২০১৩ সালের একটি ঘটনায় ফিরে তাকানো যাক। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এরপর সারাদেশে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরমধ্যেই ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে’ এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। যা চলমান সংঘাত-সহিংসতাকে আরও উসকে দেয়। কয়েকদিনের টানা সংঘাতে পুলিশ সদস্যসহ নিহত হন ৬০ জনের বেশি মানুষ।

পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজবটি ছড়িয়েছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও এর এক জামায়াত নেতা। যা ফেসবুকের মাধ্যমে আগুনের গতিতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। গুরুতর অবনতি ঘটিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির।

২০১৮ সালের আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী ঢাকা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব আন্দোলনে উত্তাল ছিল। এই আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে ধানমন্ডির জিগাতলায় উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে আলোচনার নামে ডেকে নিয়ে তিনজন নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে বলে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবটি ছড়িয়ে দিতে কিছু শিক্ষার্থী ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের ফোন করেছিলেন।

অন্যদিকে এই গুজবের তথ্য যথাযথভাবে যাচাই না করেই, ২-৩ তিন শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে এমন বক্তব্য দিয়ে বেশ নাটকীয় ঢংয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন অভিনেত্রী নওশাবা আহমেদ। অভিনেত্রীর ওই ভিডিও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। পরে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছিল অভিনেত্রীকে।

এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে। মধ্যপ্রাচ্যে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ চলছে। ৭ সেপ্টেম্বর হামাস যোদ্ধাদের আকস্মিক অভিযানের পর শুরু হয়েছে ইসরাইলি তাণ্ডব। এখন চলছে একতরফা বর্বর আক্রমণ। ধূলিসাৎ হচ্ছে ঘর-বাড়ি, মসজিদ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কংক্রিটের চাপায় নিহত হচ্ছেন শত শত মানুষ।

এমন বাস্তবতায় মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে এই সংঘাত। যা নিয়ে হাজার হাজার ভুল তথ্য (ছবি ও ভিডিওসহ) ছড়িয়ে পড়ছে। যা আবার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও শেয়ার করছেন। চলছে পক্ষে-বিপক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা। এই সংঘাত নিয়ে ছড়িয়ে প্রধান অপতথ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলি জেনারেল নিমরদ আলোনিকে আটক করে গাজায় নিয়ে গেছে।

এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলকে ৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছেন এবং সংঘাত বন্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন-এমন খবরও ছড়িয়ে পড়েছে। বার্তা সংস্থা এপি তথ্য যাচাই করে দেখিয়েছেন এই তথ্যগুলোর সবই ছিল ভুয়া। যদিও কোনো সত্যাসত্য যাচাই ছাড়াই এই তিনটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ শেয়ার করেছেন। যার অগ্রভাগে ছিল ‘এক্স’ নামের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

লেখার শুরুতে বলা আছে, বিভিন্ন ধরনের সংকট, যুদ্ধ ও সংঘাতের সময় অপতথ্য বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই ধরনের তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন। এইক্ষেত্রে ২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এই নির্বাচনে পরিকল্পিতভাবে ভুয়া খবর ছড়িয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়েছিল। যার ইতিবাচক ফল পেয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এই সময় সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়া ভুয়া খবরের তালিকায় ছিল ‘Pope Francis shocks world, endorses Donald Trump for president’ শিরোনামের সংবাদটি। অর্থাৎ খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু পোপ ফ্রান্সিস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন এমন তথ্য মার্কিন ভোটারদের বেশি প্রভাবিত করেছিল।

এরপরের সংবাদটি ছিল মার্কিন মেরিন সেনাদের নিয়ে। এই সময় ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ছাপা হয় ‘Donald Trump sent his own plane to transport 200 stranded marines’ শিরোনামের সংবাদটি। যা ছিল ভুয়া। একইসাথে ভোটারদের সামনে হিলারি ক্লিনটনকে হেয় করতে নানা ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হয়। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ISIS leader calls for American Muslim voters to support Hillary Clinton’ শিরোনামের সংবাদটি।

বিভিন্ন ধরনের সংকট, যুদ্ধ ও সংঘাতের সময় অপতথ্য বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই ধরনের তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন।

ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়া এই সংবাদটি সামলাতে হিলারির নির্বাচনী দলকে ভীষণ বেগ পেতে হয়। আর নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর হিলারি ক্লিনটন তার প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথাকথিত ভুয়া খবরের বাস্তব জীবনে মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। তিনি ভুয়া খবরকে গণতন্ত্রের জন্য এক ধরনের বিপদ বলে অভিহিত করেন।

চলতি বছরের শেষ সপ্তাহ অথবা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন বাংলাদেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সংখ্যাও দিন দিন হু হু করে বাড়ছে। আর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন প্রায় ৫-৬ কোটি মানুষ।

সংবাদ, তথ্য, মতামতের জন্য দেশের মানুষ এখন বেশি নির্ভরশীল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফেসবুকের ওপর। এমন বাস্তবতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এক ধরনের লড়াই হবে তা বলা বাহুল্য। নিশ্চিতভাবেই বড় দুই পক্ষ তাদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুককে ব্যবহার করতে চাইবেন। অনেক উদাহরণ দেখে অনুধাবন করা যায়, এই প্রক্রিয়া এরইমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

ফেসবুকে সক্রিয় ‘খোয়াবনামা’ নামক একটি পেজে ১৪ অক্টোবর প্রকাশ করা হয় ‘বিএনপি’র পর ইসরাইলের পক্ষ নিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস’। একইসাথে ড. মুহম্মদ ইউনূস ইসরাইলকে ১০০ কোটি টাকা দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। একইসাথে বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন, ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে... এমন ধরনের প্রচারণা ভিডিও, ছবি ও গ্রাফিক্সে সয়লাব বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা যে আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তাই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াকে যুক্তিসঙ্গত করা এবং সংঘাত-সহিংতাকে উসকে না দেওয়ার জন্য যাচাইকরণ তীব্র জরুরি। নিজেকে নিরাপদ রাখতে, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সবারই উচিত যাচাইকরণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা।

রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়