তখনো বিশ্বকর্মা পূজা কেবলমাত্র রিকশাস্ট্যান্ড আর অটোস্ট্যান্ডেই হতো না। ইতিউতি অনেক কারখানার ধোঁয়া বাতাসে মিশতে মিশতে দিব্যি ফুসফুসেও মিশে যেত, আর তার জন্য কোথাও কারও কাশি হয়েছে বলেও শুনিনি।

খুব বেশিদিন আগের কথা কিন্তু নয়। তবু মনে হয় যেন সম্পূর্ণ আলাদা একটা পৃথিবী আমাদের জড়িয়ে রেখেছিল। কলাবউয়ের স্নান দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা আজকালকার বাচ্চারা কল্পনা করতে পারে?

স্মার্টফোনে গেম খেলবার কিংবা অন্যান্য ‘গেম’ দেখবার নেশা থেকে কখনো সরে এলে পরে তারা কি টের পাবে যে অতি চালাক নয় এমন মানুষের কাছেই পৃথিবী তার রূপ-রস-গন্ধের কলসি আরও বেশি করে উপুড় করে দেয়?

কোথাও একবার পড়েছিলাম, দুর্গাপূজার উৎসব প্রাধান্যের জন্যই পূজাক্ষেত্রে দুর্গা প্রাধান্য লাভ করলেন না, করলেন কালী এবং দশমহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীরা। কিন্তু সাধনা কি কেবলমাত্র কোনো সাধকের গুহায় বসে দেবীর ধ্যান করা?

একজন মানুষের অনেক মানুষের অংশ হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া, তাও কি প্রকৃতিতে আঙুল দিয়ে মহাপ্রকৃতিকে অনুভব করারই সাধনা নয়? সেই কারণেই তো সিদ্ধিলাভ করার পরও সন্ন্যাসীরা পাহাড় থেকে নেমে আসেন সমতলে। শিক্ষার পরের ধাপ যে লোকশিক্ষা তাকে অনুভব করার জন্য।  

আমাদের অনুভবে, ছিল ছিটের জামা, ছিল খেলনা পিস্তল থেকে ক্যাপ ফাটানোর দেদার আনন্দ, আর ছিল শহরের প্রান্তে ফুটে ওঠা কাশফুল।

আমাদের অনুভবে, দূর্গাপূজা দ্বিতীয়া থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না। ছিল না এত আলো, এত রোশনাই, এত টাকার ঝনঝনানি। ছিল ছিটের জামা, ছিল খেলনা পিস্তল থেকে ক্যাপ ফাটানোর দেদার আনন্দ, আর ছিল শহরের প্রান্তে ফুটে ওঠা কাশফুল।

সবচেয়ে বেশি করে ছিল, একটা পূজা ঘিরে অনেক পরিবারের উৎসাহ। মা দুর্গা তখন পঞ্চমীর রাতে মণ্ডপে আসতেন। আর স্কুল চলত পঞ্চমীর বিকেল অবধি। ষষ্ঠীর বোধন যেন রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো আমাদের সবাইকে একটা শীতঘুম থেকে জাগিয়ে তুলত।

আসছে দিনগুলোয় রোজ বই মুখে করে বসতে হবে না, এই আনন্দটাই ছিল পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। তার সঙ্গে জুড়ে যেত কাছে-দূরে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা।

সেইসব প্রতিমার নির্মাণে শিল্প ছিল, কিন্তু থিমের আতিশয্য ছিল না। মা দুর্গাকে চেকোস্লোভাকিয়ার জিমন্যাস্ট মনে হবে এই রকম ঠাকুর ছোটবেলায় দেখিনি, হলফ করে বলতে পারি।

যা দেখতাম, যাকে দেখতাম, তাকে মাটিতে মাথা রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে ইচ্ছে হতো। প্রণামের শেষে প্রসাদ পেলে, প্রসাদ খেয়ে হাতটা মাথায় মুছে ফেলার ইচ্ছা হতো, যাতে স্বাদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও আশীর্বাদ বেঁচে থাকে।

মা দুর্গা তখন পঞ্চমীর রাতে মণ্ডপে আসতেন। আর স্কুল চলত পঞ্চমীর বিকেল অবধি। ষষ্ঠীর বোধন যেন রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো আমাদের সবাইকে একটা শীতঘুম থেকে জাগিয়ে তুলত।

মিস করি। সেই পূজাটাই খুব মিস করি। যে পূজার দশমীর সন্ধ্যাতেই ভাসান হয়ে যেত। ভাসানের আগে লরির সামনে যে ছেলেগুলো নাচত, ভাসান থেকে ফেরার পথে তাদের নাচের ভঙ্গি যেত বদলে।

কোত্থেকে যেন অনেকখানি বিষণ্নতা এসে মিশে যেত বাতাসে, ভিড় বাড়াত ফুসফুসে। চালের ভেতর থেকে পাথরকুচি বের করার চাইতেও অনেক বেশি কষ্ট হতো সেই বেদনাকে বুক থেকে সরাতে।

তারপর একসময় মণ্ডপের খাঁ খাঁ শূন্যতা থেকেই জন্ম নিত প্রতীক্ষা, পাল্টাতে থাকা ঋতু কখন যেন আবারও রোদের গায়ে রাংতার আভাস দিয়ে যেত। আজও যায়।

এবার কি আবার সেই রকম পূজা পাব? নাকি, কোমরে দড়ি দিয়ে যাদের জেলে নিয়ে যাওয়া উচিত সেইসব চিটফান্ড মালিকরা,  ‘ঘনিষ্ঠ’র বাড়িতে কোটি কোটি টাকা রাখা নেতা-মন্ত্রী-মাতব্বরদের পাশে দাঁড়িয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসবে মঞ্চে?

মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল তবু তেমনটা হলে আর ঠাকুর দেখতে বেরোবো না এই বছর। পাপ ধ্বংসকারী দেবীর আরাধনা পুণ্যে হোক, আনন্দে হোক, সাত্ত্বিক হোক। সেইসব দিনে অপেক্ষায় থাকতে খুব ভালো লাগে।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক (ভারত)