হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করেছে, এতে আমাদের কী?
হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করেছে। এটা নিয়ে নিখিল বিশ্ব বেশ মাতামাতি করছে। শোরগোল শুরু হয়েছে নানান বৈশ্বিক ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে। বিশ্বরাজনীতির ভরকেন্দ্রগুলো নিজেদের হিসাব নিকাশ অনুযায়ী ‘সাইড’ (পার্শ্ব) নিচ্ছে এবং হিসাব বুঝে ডায়ালগ (ক্যালকুলেটিভ ডায়ালগ) দিচ্ছে। ‘ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার মতো!’
তা না হলে চীন কেন নিরপেক্ষ ভান করে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে জোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে পরোক্ষভাবে হামাসের আক্রমণকে সমর্থন করবে (কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিনা প্রশ্নে এতদিন ধরে ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে)। কিংবা রাশিয়া কেন চীনের টোনে হামাসের আক্রমণকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান করবে (কারণ যুক্তরাষ্ট্র বামে গেলে রাশিয়া ডানে যাবে আর যুক্তরাষ্ট্র উত্তরে গেলে রাশিয়া দক্ষিণে যাবে!)।
বিজ্ঞাপন
আর ইরান, সৌদি আরব এবং তুরস্ক এই আমক্রণকে ‘জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ’ হিসেবে সরাসরি সমর্থন করছে। ভারত সবসময়ের মতোই ইসরায়েলের পক্ষে, কারণ চীনের সাথে ‘বিরুদ্ধবাদিতা’ আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সুদীর্ঘ মিল-মহব্বত! যুক্তরাজ্যের তো বিশ্বরাজনীতিতে নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। এরা সর্বদাই যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ার নিচে বসবাস করে। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া ‘হামাস ইসরায়েলে কেন হামলা করতে বাধ্য হয়েছে’ এবং ‘পরিস্থিতি এই পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য’ ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। উত্তর কোরিয়ার এই অবস্থানের কারণ নিঃসন্দেহে প্যালেস্টাইনের জন্য বেশুমার দরদ নয় কিংবা হামাসের ‘সন্ত্রাসী’ হামলার পক্ষে সমর্থন নয়, বরঞ্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেয়ারের রাষ্ট্র আক্রান্ত হওয়ার আনন্দ।
মূলত সবকিছুই বিশ্ব পরিমণ্ডলের ক্ষমতার রাজনীতি। ক্ষমতা বলয় সৃষ্টির ও আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। বন্ধুর বন্ধু, বন্ধু কিংবা শত্রুর বন্ধু, শত্রু বা বন্ধুর শত্রু, শত্রুর রাজনীতি। বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব যারা বোঝেন এবং বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব নিয়ে যারা এসব ‘ডায়ালগবাজি’ এবং ‘সাইড-নেওয়ার বাকোয়াজ’কে বিশ্লেষণ করতে পারেন তারা হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন।
মূল জিজ্ঞাসা হচ্ছে, হামাস ইসরায়েল অধ্যুষিত গাজায় আক্রমণ করেছে এবং বড় মাপের আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে, অসংখ্য ইসরায়েলিদের বন্দি করেছে, ইসরায়েলের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে রীতিমতো না-মরদ বানিয়ে ছেড়েছে, কিন্তু গাজা উপত্যকায় হামাস আক্রমণ করলে আমাদের কী? আমরা এসব নিয়ে এত মাতামাতি করছি কেন?
বাংলাদেশ সবসময় স্বাধীন প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এইবারও কার্যত তাই হয়েছে। কিন্তু হাজার মাইল দূরে হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করেছে এতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কী যায়-আসে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’ অনুযায়ী ‘প্যালেস্টাইন আমাদের বন্ধু আবার ইসরায়েল আমাদের শত্রু নয়’ জাতীয় অবস্থান থাকলেও বাংলাদেশ সবসময় স্বাধীন প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এইবারও কার্যত তাই হয়েছে। কিন্তু হাজার মাইল দূরে হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করেছে এতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কী যায়-আসে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং এদের মিত্ররাষ্ট্রগুলো হামাসকে একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে দাবি করে এবং হামাসের পরিচয়কে সেইভাবেই বাজারজাত করে। কিন্তু প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশন বা পিএলও এর ক্রমবর্ধমান আপসকামিতা এবং ইসরায়েলের নিত্য অত্যাচার-নির্যাতন থেকে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা প্রদানের দৃশ্যমান ব্যর্থতার কারণে হামাস ক্রমান্বয়ে ফিলিস্তিনিদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হিসেবে।
আরও পড়ুন
এই হামলা প্রকারান্তরে মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনে হামাসকে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের কাছে পিএলও-এর জায়গায় প্রতিস্থাপন করবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের বরাতে এই হামলার প্রধানত চারটি কারণ বেরিয়ে এসেছে।
এক. বেনজামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর নিয়মিতভাবে সহিংসতা, অত্যাচার ও নির্যাতন বাড়িয়েই চলেছে। তাই, ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে একটা পাল্টা জবাব দেওয়া জরুরি এবং তা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এটা সেই প্রতি-আক্রমণের অনিবার্যতা।
দুই. আরও একটি কারণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এসেছে তা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের সাথে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে ওঠায় প্যালেস্টাইন আরব দেশগুলোর কাছে একটা ‘গড়পড়তা’ এবং ‘মামুলি’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এই অবস্থায় সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করলে স্বাধীন প্যালেস্টাইনের স্বপ্ন আর কোনোদিন বাস্তবতার রূপ দেখবে না। একটা সজোরে ধাক্কা দেওয়া জরুরি ছিল। তাই, নজিরবিহীন এই হামালা। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সিরিয়া এবং মিশর ১৯৭৩ সালে যৌথভাবে ইসরায়েলে এইরকম হামলা চালায়। সুতরাং এটা একটা বড় ধাক্কা। এবং হামাসের ভাষায় এটা জরুরি ছিল আরব দেশগুলোর নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করিয়ে দেওয়া।
তিন. হামাস মুখপাত্র খালেদ কারামের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা জানায়, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ইতি টানতেই হামাস সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ পরিচালনার মাধ্যমে দশকের পর দশক ধরে চলা ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, শোষণ ও বঞ্চনার জবাব দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং পুরো বিশ্বের মানুষ আমাদের ওপর পরিচালিত অত্যাচারের কথা জানুক। আমরা চাই আমাদের মানুষ এবং ভূখণ্ডের ওপর, পবিত্র প্রার্থনা কেন্দ্র আল-আকসার দখলদারিত্ব থেকে ইসরায়েলিরা সরে যাক। অনেক বছরের পুঞ্জিভূত অত্যাচার ও দখলদারিত্বের জবাব দিতেই আমরা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছি। প্যালেস্টাইনকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করতেই এই হামলা।
...আমাদের যায়-আসে কারণ আমরা সবসময় নির্যাতিত মানুষের পক্ষে, মানুষের নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতার পক্ষে, আমরা যেকোনো ধরনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে...
দাবি অনেক কিছু করা যায় কিন্তু আমার মনে হয় না, এই হামলার মধ্য দিয়ে গাজা এবং প্যালেস্টাইন অধ্যুষিত এলাকা ইসরায়েল দখলমক্ত হবে। তবে, প্রতিরোধের একটা ধরন হিসেবে একে বিবেচনা করা যায়।
চার. প্রকৃতপক্ষে ২০১১ সালে তিউনেশিয়ার হাত ধরে ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আরব বসন্তের নামে পাশ্চাত্যের প্রত্যক্ষ মদদে সরকার পরিবর্তন এবং গণতন্ত্রায়নের নামে পাশ্চাত্যের ‘বন্ধুবর’ সরকার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে আরব এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের কারণে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরও পড়ুন
ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কারণে এবং ইরানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হামাস পুরো আরব ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পশ্চিমা বিরোধী দর্শন ও প্রতিবাদের একটা প্রতীক হয়ে ওঠে। এবং এই কারণে ইরান হামাসকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে। ফলে, এই আক্রমণ ইসরায়েলকে জানান দেওয়া যে, হামাস যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে আঘাত করতে সক্ষম।
এই রকম আরও কিছু কারণ হয়তো যুক্ত করা যাবে। কিন্তু মূল পয়েন্ট হচ্ছে, এতে করে আমাদের কী যায়-আসে? আমাদের যায়-আসে কারণ ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল একটি দখলদারি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্যালেস্টাইনের সাধারণ জনগণের ওপর যেভাবে নিয়মিতভাবে সহিংসতা, অত্যাচার, নির্যাতন করে আসছে, তাদের পক্ষ থেকে যেকোনো প্রতিরোধ আন্দোলন এবং প্রতিঘাত সমর্থনযোগ্য।
নির্যাতিত মানুষের প্রতিঘাত বিশ্বমানবতার মানদণ্ডে ইতিবাচক। আমাদের যায়-আসে কারণ আমরা সবসময় নির্যাতিত মানুষের পক্ষে, মানুষের নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতার পক্ষে, আমরা যেকোনো ধরনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে, যেকোনো ধরনের বহিঃশক্তির আশকারায় সিভিলিয়ানদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি আমরা মানুষ ও মানবতার পক্ষে।
আমার প্রজন্ম আজন্ম ‘ইসরায়েলি কর্তৃক ফিলিস্তিনি নির্যাতন’-এর বয়ান শুনে বেড়ে উঠেছে। তাই, ‘ফিলিস্তিন (হোক সেইটা হামাস) কর্তৃক ইসরায়েল’কে প্রতিঘাত আমাদের মধ্যে খানিকটা আরাম দেয় বৈকি! তবে, আমি সবসময় সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটির বিরুদ্ধে। সেইটা হোক ফিলিস্তিনি কিংবা ইসরায়েলি! মানুষ আগে, রাষ্ট্র পরে!
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ।। নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়