ছবি : সংগৃহীত

অবশেষে এই দিনটিও দেখতে হলো! কুমিল্লার মতো একটি জনবহুল শহরে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক দামামা বাজল। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলে হামলা করল স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারীরা। তবে কি বলব যে, আগ্নেয়গিরির উৎসমুখ খুলে গেল?

যারা এসব করছেন, তাদের রাজনীতি পরিষ্কার। এরা আওয়ামী লীগ করলেও স্বাধীনতার চেতনা পরিপন্থী। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এরা কী করতে চলেছেন, তার আগাম কোনো তথ্য কি পুলিশ বা ইনটেলিজেন্সের কাছেও ছিল না? যদি না থাকে, তার দায় কার? আর থাকলে কি সব জেনেও এমন উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে আগুন নিয়ে খেলার প্রশ্রয় জোগানো হয়েছিল?

শারদীয় দুর্গাপূজার ঠিক আগে আগে কুমিল্লায় হামলা হয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলে। দৈনিক কালবেলা বলছে, হামলা করেছে কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম বাহাউদ্দিন বাহারের লোকজন।

সম্প্রতি শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে কটূক্তি করে আলোচনায় আসেন কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য বাহার। ৪ অক্টোবর ২০২৩ কুমিল্লায় পূজার প্রস্তুতি উপলক্ষে এক সভায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘মদমুক্ত’ পূজা উদযাপনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পূজা চলাকালে মদ খেয়ে নাচানাচি বন্ধ করতে হবে। এই সময় মণ্ডপে ‘মাদকমুক্ত পূজা’ লিখে দেবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তার এমন মন্তব্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

কুমিল্লার সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন ওরফে বাহার দুর্গোৎসব সম্পর্কেই অবমাননাকর মন্তব্যও করেছেন। তিনি তার ধর্মের আচার-নীতি নিয়ে কথা বলতে পারেন। অন্যের ধর্মের অনুসারীরা কীভাবে দুর্গাপূজা পালন করবেন, সেইসব নিয়ে নাক গলানোর অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সংসদ সদস্য হলেই অন্য ধর্মের অবমাননা করা যায় না।

বাহারের বক্তব্যে প্রতিবাদেই বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছিল বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এমপি বাহার পূজার সাথে মদের সম্পর্ক তুলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তিনি করতে পারেন কি না, সেইটাই বড় প্রশ্ন। এমপি মানেই কি তিনি জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সব মানুষের প্রভু? তিনি সবাইকে জ্ঞান দিতে পারেন? তার কথা পছন্দ না হলেই প্রতিবাদ মিছিলে হামলা করতে পারে তার লোকজন? 

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে পাওয়া স্বাধীনতা মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। তাতে বাংলাদেশ নামটা যে অনেক বড় এক স্বপ্ন, তা এসেছিল আওয়ামী লীগের হাত ধরে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ আর নেই।

সত্যি বলতে কি, বাহারের মতো সংসদ সদস্যদের নিয়ে আওয়ামী লীগে বাড়ছে বিড়ম্বনা। একটা প্রশ্ন উঠছে, এইরকম কত বাহার আছে শাসক দলে? কিংবা কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্যকে এই রকম সাম্প্রদায়িক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়?

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে পাওয়া স্বাধীনতা মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। তাতে বাংলাদেশ নামটা যে অনেক বড় এক স্বপ্ন, তা এসেছিল আওয়ামী লীগের হাত ধরে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ আর নেই। দলে এখন অসংখ্য দখলদার ও সাম্প্রদায়িক বাহার। আমরা অনেকেই এই সত্যটা বুঝতে পারছি। আর পারছি বলেই বিপন্ন বোধ করছি আজ আমরা।

আওয়ামী লীগের লোকজন যখন এইরকম আচরণ করে তখন বাংলাদেশের ঐক্যবন্ধনের যে শক্তি তাকে আলগা করে ফেলে এবং সেইখানেই আমাদের সমূহ বিপদ। একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, আজ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কথায় যারা আহত হচ্ছেন, তারা আসলে সাম্প্রদায়িক।

বাহারের মতো নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে অসহিষ্ণু তারা হয়ে উঠছেন। তবে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, মৌলবাদের জবাব আর একটি মৌলবাদকে আশ্রয় করে দেওয়া যায় না।

ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে যারা হিন্দু বা অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলে পড়ে তারা বাংলাদেশের শত্রু। কিন্তু যেসব দল হিন্দুদের ভোট ব্যাংক মনে করে তারা কারা? এইটাই সঙ্কট বর্তমান অবস্থায়।

আওয়ামী লীগ নেতারা যখন অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছেন, তারাই যখন মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছেন নিজেদের স্বার্থে, যখন তাদের উদ্যোগে জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে প্রচার, তখন দেশের সামগ্রিক রাজনীতি নিয়ে বড় ভাবনায় নিপতিত হতে হয়।

শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যখন যুক্তিকে হারিয়ে, বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন বলতেই হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে যেখানে জন্মের শুরুতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতি ছিল না এবং সম্প্রীতি বজায় রাখার যে স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল, তা ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে কেন এখন? শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যখন যুক্তিকে হারিয়ে, বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন বলতেই হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে।

এর কারণ ভোটের রাজনীতি। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সম্প্রীতির চারণক্ষেত্র বাংলাদেশে এখন অশান্তি আছড়ে পড়ছে বারবার। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা। হতাশা প্রকাশ পাচ্ছে হানাহানির মধ্যে। এবং এই হতাশা আসছে আওয়ামী লীগ থেকে এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তো আছেই।

তবে ব্যক্তি বাহার বা কোনো গোষ্ঠী কোনো টার্গেট নয়। দেশজুড়ে যে সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সঠিক অনুশীলন প্রয়োজন।

এমপি বাহারের বক্তৃতায় যে ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘৃণার উপাদান ছিল, তাতে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে খুব অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু নেওয়া হয়নি। এর আগেও কুমিল্লায় পূজায় হামলার সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।

একটা কথা পরিষ্কার যে, কুমিল্লায় যারা হামলা করেছে তাদের দুরভিসন্ধির শিকড় অনেক গভীরে। তারা যা করেছে তা এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির তৈরি করেছে। প্রশ্ন জাগে এই কি আমাদের সম্প্রীতি, সহনশীলতার ঐতিহ্য? এই জিনিস আমরা ঘটতে দেই কেন?  এ-সব প্রশ্নের জবাব খুব জরুরি।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন