পদ্মা সেতুতে ট্রেন
সম্ভাবনার নতুন পথ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী (১৯২৯)’ পড়ে চোখের জল ফেলেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। অপু আর দুর্গা, দুই ভাইবোনের সম্পর্কের যে রসায়ন, তা বাংলার চিরকালীন সম্পর্কেরই ছবি। বিভূতিভূষণের এই কালজয়ী উপন্যাসকে সেলুলয়েডের ফিতায় বেঁধেছেন সত্যজিৎ রায়।
যারা পথের পাঁচালী পড়েছেন বা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে অপু আর দুর্গার লুকিয়ে রেল দেখতে যাওয়ার কথা। কাশবনের ফাঁক গলে দুই ভাইবোনের অপার বিস্ময়ে জীবনে প্রথম রেল দেখার ছবি অমলিন হয়ে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
বিজ্ঞাপন
এমন আরও অনেক গল্প রচিত হতে যাচ্ছে এই বাংলাদেশে। ১০ অক্টোবর ২০২৩, পদ্মা সেতুতে রেল চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুইদিন আগে মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধির পাঠানো একটি রিপোর্ট দেখছিলাম এটিএন নিউজে। মুন্সিগঞ্জের অনেক মানুষ জীবনে রেলগাড়ি দেখলেও চড়েনি। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল দেখার আশায়। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছেন না, তাদের জীবদ্দশায় চোখের সামনে রেল চলবে।
আরও পড়ুন
এই অসম্ভবকে সম্ভব করার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রমত্তা পদ্মার ওপরে সেতু বানানো যাবে, এইটাই একসময় কল্পনার অতীত ছিল। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর তো একজন ছাড়া সবাই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না। সেই একজনের নাম শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু কন্যার বুক ভরা সাহস। তিনি বিশ্বব্যাংককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু গড়েছেন। পদ্মার ওপর দিয়ে গাড়ি চলছে, এইটাই ছিল বিস্ময়। এখন সেই বিস্ময়কেও হার মানিয়ে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে লম্বা ট্রেন চলবে কু ঝিক ঝিক করে। মানুষের কল্পনার সীমাও কখনো কখনো বাস্তবের কাছে হার মানে।
আশির দশকে আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে বাংলাদেশ ছিল সামরিক শাসকদের বুটের তলায় পিষ্ট। ভোট দেওয়া তো দূরের কথা, কথা বলার স্বাধীনতাও ছিল না। রাস্তায় নামলেই টার্গেট করে গুলি চালানো হতো। তখন বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর বন্যার দেশ। আমাদের বাজেট হতো বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ভর করে।
প্রমত্তা পদ্মার ওপরে সেতু বানানো যাবে, এইটাই একসময় কল্পনার অতীত ছিল। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর তো একজন ছাড়া সবাই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না।
স্বাধীন দেশের নাগরিক হলেও আমাদের হীনমন্যতা কাটেনি তখনো। ছেলেবেলায় বইয়ে পড়েছি বা চলচ্চিত্রে দেখেছি বা বিদেশে গিয়ে দেখে আফসোস করতাম; এসব অনেককিছু এখন আমাদের চোখের সামনে। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। ঘুম থেকে উঠলেই বুঝি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। কিন্তু স্বপ্ন নয়, সবই বাস্তব।
যতই আওয়ামী লীগ বিরোধী হোন বা শেখ হাসিনার সমালোচনা করুন; বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনি কি ভেবেছিলেন এই বাংলাদেশে মেট্রোরেল হবে, সাবমেরিন হবে, স্যাটেলাইট হবে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে গাড়ি চলবে, ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেন যোগাযোগ হবে।
তারপরও একটা কথা আছে, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। শেখ হাসিনাকে যারা সহ্যই করতে পারেন না, তারা বলছেন; এসবই তো জনগণের করের টাকায় হয়েছে। শেখ হাসিনা তো তার নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাননি। এইসব আসলে কুতর্ক। কোনো দেশের সরকার প্রধানই নিজের টাকায় কিছু বানান না। জনগণের টাকায় জনগণের উন্নয়ন করতে হয়। কিন্তু তার জন্য থাকতে হয় দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা। আগেও তো অনেকে ক্ষমতায় ছিলেন। এমন অভিনব উন্নয়ন ভাবনা তাদের মাথায় আসেনি কেন?
আরও পড়ুন
আমরা অনেক মেগা প্রকল্পের কথা বলি। কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই যে বাংলাদেশটা বদলে গেছে তা আমাদের চোখেই পড়ে না। মায়ের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা সন্তানকেও মায়ের কাছে সবসময় ছোটই লাগে। তাই বাইরে থেকে কেউ এলে হঠাৎ বাংলাদেশ দেখে চমকে যান, মেলাতে পারেন না। বাংলাদেশে এখন আর দুর্গম বলে কোনো এলাকা নেই। সড়কে, রেলে, সেতুতে, কালভার্টে গোটা বাংলাদেশ এখন সংযুক্ত।
রেল হলো সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক বাহন। ব্রিটিশদের করা রেল নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করেই চলছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রেলওয়ের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করেছে। বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের রেলের অবকাঠামো। রেলওয়েতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজার যাওয়া এখন অপেক্ষা মাত্র। ঢাকা থেকে কুয়াকাটায়ও ট্রেনে যাওয়া যাবে বলে শুনছি। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৩ জেলায় বর্তমানে রেলপথের মাধ্যমে যাত্রী চলাচল করে। সরকার ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে ২০৪৫ সালের মধ্যে ৬৪ জেলাকেই রেলপথের আওতায় আনতে চায়। পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল শুরু সেই স্বপ্নের পথচলায় এক নতুন মাইলফলক।
পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল, নিছক আরেকটি প্রকল্প নয়। খুলে দেবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। এই প্রকল্পে ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
রেল হলো সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক বাহন। ব্রিটিশদের করা রেল নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করেই চলছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রেলওয়ের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করেছে।
২০২৪ সালে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। ১০ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হচ্ছে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিমি রেলপথে ট্রেন চলাচল। পদ্মা সেতু ঘিরে নতুন রেলপথ বদলে দেবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের রেল নেটওয়ার্ক।
বর্তমানে রেলপথে ঢাকার সঙ্গে খুলনার দূরত্ব ৪৬০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু হয়ে যশোর রেলপথে যাতায়াতে রাজধানী থেকে খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। এতে সময় বাঁচবে প্রায় তিন ঘণ্টা।
মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর রেল রুট। পদ্মা সেতুর রেল রুটটি পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতকে সংযুক্ত করে বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাঙ্গা-মাওয়া হয়ে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-টঙ্গী-আখাউড়া-চট্টগ্রাম-দোহাজারী হয়ে মিয়ানমারের গুনদুম সীমান্তে গিয়ে মিশবে।
এই রুটকে ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের সাব-রুট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, দ্বার খুলে দেওয়া এবং সংযোগ বাড়ানো। এরইমধ্যে ভারতের সঙ্গে আমাদের সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবারে আমরা মিয়ানমারকে সংযুক্ত করতে যাচ্ছি। সেইখান থকে চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে। এই রুটের মাধ্যমে আরও অনেক দেশে যেতে পারবো। অর্থাৎ, সম্ভাবনা অনেক।
ভবিষ্যতে বরিশাল ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরকে এই রুটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা ছাড়াও ট্রেনের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন সহজ হবে, দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে।
সবকিছুর পরও যেকোনো প্রকল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাটাই আসল। ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হতে যাওয়া এই প্রকল্পের ফলে জিডিপি বাড়বে অন্তত এক শতাংশ।
এভাবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ