মেঘনাদ সাহা : আলোকোজ্জ্বল বাঙালি বিজ্ঞানী
আজ ৬ অক্টোবর। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জন্মদিন আজ। আজকের এই দিনে ১৮৯৩ বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার শেওড়াতলী গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তার বড় ছেলে অজিত সাহার এক চিঠি থেকে মেঘনাদ সাহা হওয়ার গল্প জানা যায়। মেঘনাদ সাহার জন্মের দিনে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঝড়বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দিন জন্মের কারণে দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল ‘মেঘনাথ’।
বিজ্ঞাপন
নামকরণ দেবতার নামানুসারে হলেও নানা জায়গায় যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আশ্রয়দাতার বাড়িতে কিংবা কখনো সরস্বতী পূজার অঞ্জলির সময় গ্লানিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হতো। সম্ভবত বিভিন্ন সময় এই গঞ্জনা, অপমান ও বিদ্বেষ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য তিনি তার পিতৃপ্রদত্ত নাম পরিবর্তন করে এমন একজনের নাম গ্রহণ করেন যিনি 'রাক্ষস' বা 'দানব' সমাজের প্রতিনিধি, লঙ্কারাজ রাবণ পুত্র 'মেঘনাদ' খ্যাত 'ইন্দ্রজিৎ'।
আরও পড়ুন
তার চোখে মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ ছিলেন, সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাকে বধ করেছিল ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। নিজের 'মেঘনাথ' নাম ত্যাগ করে তিনি 'মেঘনাদ' নাম নিয়েই তিনি জগৎ বিখ্যাত পদার্থবিদ হয়েছিলেন।
মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের কতজন মানুষ মেঘনাদ সাহা সম্বন্ধে জানে? কতজন জানে যে মেঘনাদ বাংলাদেশে জন্মেছেন? কতজন জানে তিনি কত বড় বিজ্ঞানী ছিলেন? তার জীবনী কি আমাদের স্কুলের বাচ্চাদের পাঠ্য?
ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মেঘনাদ ১৯১১ সালে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেইখানে তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহপাঠী। দুজনেই ছিলেন তুখোড় ছাত্র এবং একইসাথে ছিলেন পরম বন্ধু।
আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের আমাদের বড় বড় মানুষদের জীবনী না জানায় তারা অনুপ্রেরণা পাবে কোথা থেকে? আশার কথা হলো কয়েকদিন রামপুরা বনশ্রীতে ইন্টেলিজেনসিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করে। সেইখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারা মেলার নাম রেখেছে ‘মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান মেলা’।
এটা দেখে আমি খুবই আপ্লুত হয়েছিলাম। এইরকম এর আগে কখনোই দেখিনি। এই নাম দেখেই আমি ওই মেলায় যাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। স্কুলটি দেখে এবং এর শিক্ষক ছাত্রদের উৎসাহ দেখে আমার মনে হয়েছে আশার আলো একদম নিভে যায়নি।
মেঘনাদ সাহা ছিলেন বাবা-মা’র ৮ সন্তানের মধ্যে পঞ্চম। তার বড় ভাই স্কুলে অকৃতকার্য হওয়ায় বাবা ঠিক করল এদের স্কুলে পাঠানো মানে টাকার অপচয়। তাই তিনি মেঘনাদ সাহাকে তাদের মুদি দোকানে কাজ করতে লাগিয়ে দেন।
মেঘনাদের মেধা ও প্রতিভা গ্রামের এক দয়ালু ডাক্তারের নজরে আসে এবং তাকে একটি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিন্তু এই সুযোগকেও তিনি কঠিন করে তোলেন।
আরও পড়ুন
১৯০০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যখন বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিতে দুইভাগ করার প্রস্তাব দিলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে লোকাল গভর্নর মেঘনাদ সাহার স্কুল পরিদর্শনে যায় সেইখানে মেঘনাদ সাহা বাংলাকে দুইভাগে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে বলায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করে।
সেইবারও তিনি আরেকজন ভালো মানুষের সুনজরে পড়েন। এক প্রিন্সিপাল তার মেধার পরিচয় পেয়ে তাকে নিজের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। এই সুযোগকে মেঘনাদ সত্যি সত্যি কাজে লাগান। সেইখানে অনেকগুলো সাবজেক্ট যেমন অ্যাস্ট্রোনমি কেমিস্ট্রিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সবার নজর কাড়েন। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজে।
ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মেঘনাদ ১৯১১ সালে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেইখানে তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহপাঠী। দুজনেই ছিলেন তুখোড় ছাত্র এবং একইসাথে ছিলেন পরম বন্ধু। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছাড়াও আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ তার সহপাঠী হন যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নিখিলরঞ্জন সেন, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রনাথ গুহ, সুরেন্দ্র নাথ মুখার্জী প্রমুখ।
এদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাক্রমে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন ছিলেন। পরবর্তীতে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ বর্তমান ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সাইন্সের পরিচালক হয়েছিলেন। জানা যায়, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বেই ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সাইন্স সুনাম অর্জন করে।
মেঘনাদ ১৯২৮ সালে তার সব গবেষণার ফলাফল একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করার জন্য তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জী তার থিসিস পেপার বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
বিদেশে অধ্যাপক ডাবলু রিচার্ডসন, ড. পোর্টার এবং ড. ক্যাম্বেল তার থিসিস পেপার পর্যালোচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯১৯ সালে তাকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করেন। একই বছর মেঘনাদ, প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে গবেষণার সুযোগ পান।
এরপর ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম পাঁচ মাস লন্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের পরীক্ষাগারে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সাথে কাজ করেন। এই সময়ের আশপাশে তিনি কিছু যুগান্তকারী গবেষণা করেন যেগুলো সেই সময়ের বিখ্যাত জার্নাল যেমন ফিলোসোফিক্যাল ম্যাগাজিনে ও রয়েল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত জার্নালে প্রকাশ করেন।
এর মধ্যে ‘On a physical theory of stellar spectra’ শিরোনামের আর্টিকেলটি মেঘনাদ সাহার জীবনের সেরা কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আর্টিকেলে একটি সমীকরণ এখন ‘সাহা সমীকরণ’ নামে সবাই জানে। এটি নক্ষত্রের শ্রেণিবিভাগ বিশেষভাবে কাজ করে। এই সমীকরণটি বিখ্যাত হওয়ার পেছনে আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ‘লেডিস গ্রুপ’-এর বিশেষ কৃতিত্ব আছে।
হার্ভাডের ওই মহিলা সহকারী বিজ্ঞানীরা তখন আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের তারাগুলো কতটা উজ্জ্বল আর তাদের সেই উজ্জ্বলতায় কেন বাড়া-কমা হয়, তা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র নক্ষত্রগুলো তারা সাতটি দলে ভাগ করেছিলেন।
‘O’, ‘B’,‘A’, ‘F’, ‘G’, ‘K’ এবং ‘M’ যাকে সংক্ষেপে মনে রাখার জন্য বলা হয় Oh Be A Fine Guy and Kiss Me। সেই লেডিস গ্রুপ দেখলেন তারার উজ্জ্বলতা বাড়লে বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখার উজ্জ্বলতা বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে। কেন বাড়তে পারে আবার কমতেও পারে তার ব্যাখ্যা পেয়েছিলেন সাহা সমীকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন
মেঘনাদ সাহার এই কাজের জন্য পাঁচবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। প্রথমবার, ডি.এম. বোস ও শিশির কুমার মিত্র ১৯২৯ এবং ১৯৩০ সালে মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিলেন। নোবেল কমিটি সাহার কাজের মূল্যায়ন করেছে এবং বলেছে তার কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এটি ‘আবিষ্কার’ নয়। তাই তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
মেঘনাদ ১৯৩৭ এবং ১৯৪০ সালে এএইচ কম্পটন দ্বারা পুরস্কারের জন্য আবার মনোনীত হন; এবং ১৯৩৯, ১৯৫১, ১৯৫৫ সালে এস.কে. মিত্রা তাকে মনোনীত করেন। নোবেল কমিটি তার আগের সিদ্ধান্তে অটল।
এর মধ্যে ‘On a physical theory of stellar spectra’ শিরোনামের আর্টিকেলটি মেঘনাদ সাহার জীবনের সেরা কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আর্টিকেলে একটি সমীকরণ এখন ‘সাহা সমীকরণ’ নামে সবাই জানে।
১৯২১ সালে যখন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সেই বছরই মেঘনাদ সাহা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই দুজনের বন্ধুত্ব আজীবন অক্ষুণ্ন ছিল। একবার ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন তার যুগান্তকারী কাজটি করছিলেন মেঘনাদ সাহা ঢাকায় বেড়াতে আসেন এবং সাথে করে নিয়ে আসেন পাউলির পেপার, আইনস্টাইন এবং এহরেনফেস্ট এর আর্টিকেল।
দুটি আর্টিকেলই ছিল ব্লাকবোডি রেডিয়েশনের ওপর। বোসের আর্টিকেলটির লেখা সম্পন্ন করার জন্য এই আর্টিকেল দুটি তখন খুবই প্রয়োজন ছিল। বিজ্ঞানের জগতে সেই সময়টা বাঙালির রেনেসাঁ এনেছিলেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, আশুতোষ মুখার্জীসহ আরও অনেকেই।
একটি দেশ সামনে আগানো ও উন্নত হওয়ার শুরুর জন্য কোটি কোটি মানুষের কন্ট্রিবিউশনের প্রয়োজন নেই। হাতেগোনা কয়েকজন বিজ্ঞানীই উন্নতির launching pad হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুন
গ্রিক সভ্যতার জন্য ছিলেন সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল প্লেটোর মতো কয়েকজন। এই কাজ শুরুর জন্য আমাদের দরকার একটা বিশ্ব মানের ইন্সটিটিউট খোলার মাধ্যমে। এত বছরে আমরা এটি এখনো শুরুই করলাম না। আশা করি আমাদের সরকার বিজ্ঞানে রেনেসাঁ আনার জন্য আর কাল ক্ষেপণ করবেন না।
কারণ জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নয়ন ছাড়া একটি দেশ সত্যিকারের উন্নত দেশ হতে পারে না। এই মাটিতে যে বড় মাপের বিজ্ঞানীর জন্ম হতে পারে সেটা তো মেঘনাদ সাহার জীবনী দেখলেই বোঝা যায়। এই মাটিতেই তো জন্মেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এই মাটিতেই জন্মেছেন অমর্ত্য সেন। এখন দরকার পরিবেশ।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়