ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতি একটা গুরুত্বপূর্ণ মাসে প্রবেশ করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নভেম্বরের শুরুতে ঘোষিত হবে নির্বাচনের তফশিল। তার আগে, মানেই অক্টোবরেই ফয়সালা হবে আগামী রাজনীতির গতিপথ।

দুই দলই এখন চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। দুই দলই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগের একদফা আন্দোলনে মাঠে আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। আসলে দুই দলেরই অস্তিত্বের লড়াই।

১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। কারণ এবারও ক্ষমতায় যেতে না পারলে সংগঠন হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। আওয়ামী লীগও যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আওয়ামী লীগ জানে, ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেনও, ক্ষমতা হারালে তাদের টিকে থাকাও কষ্টকর হয়ে যাবে।

সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে থাকলেও বিএনপির মূল সংকট নেতৃত্বে। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দণ্ড মাথায় নিয়ে সরকারের অনুকম্পায় বাসায় আছেন। বিএনপি পদত্যাগের দাবি তো দূরের কথা, উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠানোর দাবিটিও আদায় করতে পারেনি।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল চালাচ্ছেন তিনি। নেতৃত্বের সংকটে আন্দোলন গতি পাচ্ছে না।

বিরোধী দলের চেয়ে সরকারি দলের সমস্যা অবশ্য বেশি। টানা তিন মেয়াদের ক্ষমতাসীন-বিরোধী সমস্যা তো আছেই, আছে দেশি-বিদেশি নানা চাপ। যে অর্থনীতি দিয়ে সরকার গণতন্ত্রকে আড়াল করতে চাইছিল, সেই অর্থনীতিই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। রপ্তানি কমছে, রেমিট্যান্স কমছে; চাপ বাড়ছে রিজার্ভের ওপর।

দুই দলই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগের একদফা আন্দোলনে মাঠে আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।

তারচেয়ে বড় কথা হলো, মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। মাঠে বিরোধী দলকে মোকাবিলার আগে তাই সরকারকে নানাদিক সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে রাজপথ দখলে রাখতে দুই দলই মরিয়া।

১২ জুলাই সরকার পতনের একদফা ঘোষণার পর বেশকিছু কর্মসূচিতে দারুণ সাড়া ফেলেছিল বিএনপি। তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক লোক সমাগমে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল দারুণ চাঙা হয়েছিল। কিন্তু আগস্টে গিয়ে আন্দোলনে ভাটা পড়ে। সেই ভাটার টান এখনো আছে। তবে সেপ্টেম্বরের শেষে এসে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি।

রোডমার্চ, সমাবেশ, পেশাজীবী কনভেনশন, নারী ও কৃষক সমাবেশের মতো কর্মসূচি নিয়ে এখন মাঠে বিএনপি। ধারণা করা হচ্ছে, এই কর্মসূচি শেষে বিএনপি আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে এখন তারা আন্দোলনের গিয়ার বদলাতে চাইবে।

শোনা যাচ্ছে, অক্টোবরের শেষ নাগাদ দুর্গাপূজা শেষ হলেই ঢাকা অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও, নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি আসতে পারে। বিএনপির লক্ষ্য এবার শেষ ধাক্কা দেওয়া। ১৭ বছরের বঞ্চনা ঘোচাতে তারা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে। ধরে নিচ্ছি এইসব কর্মসূচিতেও বিপুল লোক সমাগম হবে। কিন্তু তাতে সরকার পদত্যাগ করবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েই যাচ্ছে।

বিএনপি নেতারা বারবার বলছেন, হঠাৎ কোনো স্পার্ক থেকে আন্দোলন চূড়ান্ত গতি পাবে। কিন্তু সেই স্পার্কটা কী সেই সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না।

আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির কর্মসূচি ফলো করে তারা পাল্টা কর্মসূচি দেয়। তাদের মূল লক্ষ্য রাজপথের দখল যেন বিএনপি নিয়ে নিতে না পারে। বিএনপির আন্দোলনের কৌশল দেখে তারা নিজেদের কৌশল নির্ধারণ করছে। বিএনপির আন্দোলন তীব্র হলে প্রশাসনিক পদক্ষেপের বাইরে রাজনৈতিকভাবেও তাদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ। কিন্তু সমস্যা হলো তাতে সংঘাতের শঙ্কা বাড়ছে। 

বিদেশি শক্তিগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। দেশের জনগণও এই চাওয়ার সাথে একমত। সরকারি দলও অন্তত মুখে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। তবে বিদেশিদের চাপে কিছুটা স্বস্তি পেলেও সরকারের অঙ্গীকারে আস্থা রাখতে পারছে না বিএনপি।

বিএনপি বা আওয়ামী লীগ নয়; হেরে যেতে পারে রাজনীতি। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই, এটা সাধারণ মানুষ বুঝলেও রাজনীতিবিদরা বুঝতে চাইছেন না বা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন।

আস্থা রাখতে না পারলেও বিএনপি কীভাবে তাদের দাবি আদায় করবে, তার কোনো পরিষ্কার দিক নির্দেশনা নেই। তবে আন্দোলন এবং আন্দোলন মোকাবিলার কৌশল নিয়ে দুই দলই দ্বিধা ও শঙ্কায় আছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যারাই বাধা দেবে, তারা কেউই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে এই ভিসা নীতির প্রয়োগ শুরু করেছে।

বিএনপি যদি আন্দোলন গিয়ারআপ করে সহিসংতার দিকে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে ভিসা নীতি প্রযোজ্য হবে তাদের ওপরও। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালের অগ্নিসন্ত্রাসের কথা বিএনপিও নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। সেই আন্দোলনে কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে বিএনপির গায়ে অমোচনীয় কলঙ্কের দাগ লেগে গেছে।

সেই দাগ মোচনের চেষ্টায় বিএনপি নিজেদের শান্তিপূর্ণ, অহিংস দল হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হলো, চলমান অহিংস আন্দোলনে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার জ্বালাও-পোড়াও করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করলে দেশি-বিদেশি সমর্থন হারানোর ঝুঁকি থাকছে।

আবার সরকারি দলও যে গায়ের জোরে পিটিয়ে বিএনপিকে মাঠছাড়া করবে, তেমন বাস্তবতাও এখন নেই। ভিসা নীতির ভয়ে পুলিশও আগের মতো চড়াও হতে চাইবে না। ফলে দুই পক্ষকেই কৌশলী হতে হচ্ছে।

দুই পক্ষই অনড় অবস্থানে থাকলে সমস্যা সমাধানের কোনো সুযোগ নেই। আর এই অনড় অবস্থানের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ছে দেশি-বিদেশি নানা শক্তি। তবে রাজনীতিটা যেন রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকে, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে দুই পক্ষকেই। আর তাই আলোচনার একটা উপায় বের করতে হবে। আলোচনার টেবিলেই সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে হবে। না হয় সবারই ক্ষতি।

বিএনপি বা আওয়ামী লীগ নয়; হেরে যেতে পারে রাজনীতি। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই, এটা সাধারণ মানুষ বুঝলেও রাজনীতিবিদরা বুঝতে চাইছেন না বা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। দুই পক্ষই যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে মাঠে নামতে প্রস্তুত।

অনেকেই রাজনীতিকে খেলার সাথে তুলনা করেন। শামীম ওসমানের ‘খেলা হবে’ স্লোগান এখন সবার মুখে মুখে। ওবায়দুল কাদের বারবার বলছেন, খেলা হবে। বিএনপির পক্ষ থেকেও খেলার জন্য তৈরি। অনেকদিন ধরেই রাজনীতির মাঠে খেলা হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে, রাজনীতির ফাইনাল খেলাটা অক্টোবরেই হবে। কে হারবে, কে জিতবে; তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুটা সময়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ