ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে কারণে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি
ডেঙ্গুর ছোবলে মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি এবং আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুর ভয়াবহ অগ্রযাত্রা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা সফল হচ্ছি না কেন? ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আদৌ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কি? এরকম বহু প্রশ্ন এখন নানাদিক থেকে উচ্চারিত হচ্ছে।
যেকোনো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার কতগুলো মৌলিক নীতি রয়েছে। তার অন্যতম হচ্ছে শত্রুর সামর্থ্য, বিস্তৃতি, স্বভাব চরিত্র, আঘাত হানার ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা। বিষয়টি ডেঙ্গু প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
বিজ্ঞাপন
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। ডেঙ্গুর বাহক হলো এডিস মশা। এর দুটি প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হয়। এগুলো হচ্ছে এডিস ইজিপ্টাই বা গৃহবাসী এডিস মশা এবং অন্যটি হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস বা বুনো এডিস (এটাকে এশিয়ান টাইগার নামেও ডাকা হয়)।
সাধারণভাবে গৃহবাসী এডিস ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মহামারির সময়ে বুনো এডিস মশাও ডেঙ্গুর বাহকে রূপান্তরিত হয়। ডেঙ্গুপ্রবণ দেশ বা অঞ্চলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য থাকে এডিস মশা নির্মূল করা।
বছরের পর বছর ধরে মশা মারার ওষুধ কেনা হচ্ছে, ছিটানো হচ্ছে কিন্তু মশা মরছে না। কারণ ওষুধগুলো মোটেই কার্যকর নয়। মাঝখান থেকে শুধু জনগণের করের শতশত কোটি টাকা খরচ হয়েছে....
আমরা জানি পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাবে অন্যান্য প্রাণীর মতো মশার আচরণেও পরিবর্তন আসতে পারে। এজন্য মশা, বিশেষ করে এডিস মশার বাসস্থান, প্রজনন স্থল, আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা করতে হয়। বাংলাদেশে এই কাজটি একেবারেই হচ্ছে না।
সাধারণভাবে আমরা জানি এডিস মশা জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এই মশা সকাল ও সন্ধ্যাবেলায় মানুষকে কামড়ায়। ইতিমধ্যে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ তার নিজস্ব ছোট পরিসরের গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন বাংলাদেশে এডিস মশার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই মশা এখন জমে থাকা পরিষ্কার ও ময়লা-নোংরা উভয় ধরনের পানিতে ডিম পাড়ে এবং দিনরাতের যেকোনো সময় মানুষকে কামড়াতে শিখেছে। স্বাভাবিকভাবে তিনি এই নতুন তথ্য দেশবাসীকে জানালেন।
জনসাধারণ এবং ডেঙ্গু নিয়ে কর্মরত সবার মধ্যে এই নতুন তথ্য দারুণ সাড়া ফেলে দেয়। এর কয়েকদিন পর আরেকদল কীটতত্ত্ববিদ রীতিমতো সভা করে জানালেন বাংলাদেশে এডিস মশার আচার-আচরণ ও স্বভাব চরিত্রে কোনোধরনের পরিবর্তন হয়নি। যিনি পরিবর্তন বিষয়ক তথ্য দিয়েছেন তার গবেষণা গ্রহণযোগ্য মানের নয়। তাহলে সঠিক কোনটি?
তা জানতে হলে এডিস মশা নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য মানের একটি গবেষণা করা জরুরি প্রয়োজন। এবং সেই গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মশা নির্মূলের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। দুই যুগের বেশি সময় ধরে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। কিন্তু এডিস মশা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা এখনো পর্যন্ত করা হয়নি।
মশা নির্মূলের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের মতো দেশের জন্য রাসায়নিক, পরিবেশগত ও জিনগত নিয়ন্ত্রণের সমন্বয়ে গঠিত একটি কর্মকৌশল গ্রহণ করা উত্তম। রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ হলো ওষুধ দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক বা উড়ন্ত মশা এবং মশার লার্ভা বা শূককীট মেরে ফেলা।
বছরের পর বছর ধরে মশা মারার ওষুধ কেনা হচ্ছে, ছিটানো হচ্ছে কিন্তু মশা মরছে না। কারণ ওষুধগুলো মোটেই কার্যকর নয়। মাঝখান থেকে শুধু জনগণের করের শতশত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এই অর্থের বিপুল অংশ দুর্জনের পকেটে প্রবেশ করেছে।
পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এডিস মশার প্রজননস্থল ও আবাসস্থান বিনষ্ট করা। জনসাধারণের যুক্ত করে এই কাজটি দেশের কোথাও করা হয়নি। ২০১৯ সালের আগে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পরিকল্পনা সহজেই বাস্তবায়ন করা যেত। সেইসময় দায়িত্বশীলরা কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন কিন্তু মশা নির্মূলে প্রদর্শনবাদী কার্যক্রম ব্যতিরেকে তেমন কিছুই করেননি।
২০১৯ সালের মহামারির মধ্য দিয়ে ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন গৃহবাসী এডিসের সাথে বুনো এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহকে রূপান্তরিত হয়। ২০১৯ সালের আগে যে কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল বর্তমানে তা পর্বত সমান ও কঠিন হয়ে গিয়েছে।
এখন রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মশা মারার কার্যকর কর্মসূচি নির্ধারণ করা দরকার। এই কর্মসূচিতে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের সাথে পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণও যুক্ত রাখতে হবে। এই লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি ছাত্র, যুবক, স্বেচ্ছাসেবী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব স্তরের জনসাধারণ যুক্ত করে পাড়া মহল্লা এলাকা ভিত্তিক ‘মহামারি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা জরুরি।
এই কমিটি নিজ নিজ এলাকায় এডিস মশা নির্মূলের লক্ষ্যে গঠিত ‘জাতীয় মহামারি প্রতিরোধ কমিটি’-র কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এই কমিটিগুলো অন্য মহামারি (যেমন কোভিড-১৯) প্রতিরোধেও কাজ করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোনো সু-সমন্বিত জাতীয় কার্যক্রম সারাদেশে যুগপৎ বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত হয়নি।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন, সংক্রমণ ক্ষমতা, রূপান্তর ইত্যাদি নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা হয়নি এবং এখনো হচ্ছে না। ফলে এক্ষেত্রেও আমরা অন্ধকারে থেকে যাচ্ছি। এদিকেও নজর দেওয়া অতিশয় দরকার।
ডেঙ্গুর প্রবল সংক্রমণের মুখে মানুষ অসহায় এবং দিশেহারা। মানুষের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একদল অসৎ মানুষ সবসময় মুনাফা শিকারের নেশায় থাকে। করোনা মহামারির সময়ে তেমনটি আমরা দেখেছি।
এখন রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মশা মারার কার্যকর কর্মসূচি নির্ধারণ করা দরকার। এই কর্মসূচিতে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের সাথে পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণও যুক্ত রাখতে হবে।
ডেঙ্গুর এই দুঃসময়ে একদল মুনাফা লোভীর কারসাজি দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ডেঙ্গু চিকিৎসায় অতিপ্রয়োজনীয় শিরাপথে দেওয়ার স্যালাইন জাতীয় ওষুধের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দুষ্টচক্র দমন করার কোনো পদক্ষেপ জনসাধারণের চোখে পড়ছে না।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের আরেকটি দিক হলো, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা। ডেঙ্গু রোগীর শরীর থেকে রক্ত খাওয়ার পর সেই এডিস মশা কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে ওই মানুষটির শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস প্রবেশ করবে। এজন্য ডেঙ্গু রোগীকে মশারির ভেতর রাখা হয়। কিন্তু অনেক সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য মশারির ব্যবস্থা নেই। অথচ একটি বা দুইটি বিলাসবহুল গাড়ির দাম দিয়ে প্রয়োজনীয় সব মশারির জোগান দেওয়া যায়।
শুধুমাত্র চিকিৎসা দিয়ে ডেঙ্গুর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এটা শুধু আমাদের দেশ কেন পৃথিবীর কোনো দেশেই সম্ভব নয়। কারণ কোনো দেশের হাসপাতালে অগণিত সংখ্যার শয্যা থাকে না। কেবলমাত্র এডিস মশার দ্বারাই মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করে। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যকর উপায় হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল করা।
ডেঙ্গু বিরোধী লড়াইয়ে অসংগঠিতভাবে বিচ্ছিন্ন কিছু কাজ করা হয়েছে। তাতে কোনো সুফল মেলেনি। বড় বড় কথা বা মুখরোচক বক্তৃতা দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মশা মানুষের কথা সম্ভবত বোঝে না। ডেঙ্গু বিরোধী যুদ্ধে সফল হতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মকৌশল নির্ধারণ এবং জনসাধারণ যুক্ত করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ