ছবি : সংগৃহীত

সোহানুর রহমান সোহান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সফল একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম। যে নাম এখন দর্শক-পাঠকের কাছে অতীত পৃষ্ঠার স্মৃতি। অনুসন্ধানমূলক দৃষ্টিকোণে সোহানুর রহমান সোহানের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করলে প্রমাণ করবে তিনি কেবল চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন না, ছিলেন সংগঠক, শিল্প সংস্কারক এবং দুঃসাহসী সংস্কৃতিকর্মী।

গড় পছন্দে তিনি বিনোদনধর্মী সিনেমা নির্মাণের চেনা পথে ভ্রমণ করলেও তিনি ছিলেন এক কর্মীপুরুষ। যার যোগফল তার নানামাত্রিক সাফল্য। সোহানের প্রারম্ভিক যাত্রার পথ যেমন প্রশস্ত ছিল তেমনিই ছিল আলোকিত। চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, সংলাপ লেখক এবং যার খ্যাতি ছিল—‘ভেজা চোখ’, ‘তিনকন্যা’ এবং ‘আনন্দ অশ্রু’ নামের দর্শক সমাদৃত সিনেমার পরিচালক হিসেবে, তিনি শিবলি সাদিক।

চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী হয়ে সোহানুর রহমানের যাত্রা শিবলি সাদিক, এ জে মিন্টু ও সাংবাদিক, গীতিকার, ঔপন্যাসিক শহীদুল হক খানের সান্নিধ্যে এবং সোহানের অভিজ্ঞতার জগৎ পরিপুষ্ট হওয়ার সুযোগ ঘটে চলচ্চিত্র পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের বন্ধুত্বে। দুজনই ছিল তরুণ। দুজনই ছিল স্পষ্টবাদিতায় উজ্জ্বল এবং পরীক্ষাপ্রিয়।

আরও পড়ুন >>> গল্প বলার স্বাধীনতা চাই 

তাদের মনে একই সুরে অশ্লীল সিনেমার প্রতিরোধ ও বিনাশ সংগ্রামের অঙ্কুরোদগম ঘটে। অদম্য সাহসে অশ্লীল সিনেমার নির্মাতা ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। চলচ্চিত্রের সফল সংগঠনের কর্মীদের যোগ-মিশ্রণে অশ্লীলতা বিরোধী মহাআন্দোলন সফল করে।

সোহানুর রহমান সোহান শিল্পী মনের চেতনায় শিল্পী কুশলীদের দিনান্তের জীবনটা সুখী ও সুন্দর দেখতে চেয়েছেন। তাদের উৎসাহে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। সফলও হয়েছেন। কখনো হয়েছেন সমালোচিত। তবুও সোহানুর রহমানের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের মনে প্রবেশ করে তাদের আত্মউন্নয়ন ঘটানো।

সোহানুর রহমানের চলচ্চিত্র নির্মাতা পদবি ছাড়া একটি টাইটেল ছিল; বলা হতো—‘তারকাদের তারকা’। নতুনদের নিয়ে কাজ করতেন। কখনো লোকসান হওয়ার ঝুঁকি নিতেন—সফলও হতেন...

সোহানুর রহমানের চলচ্চিত্র নির্মাতা পদবি ছাড়া একটি টাইটেল ছিল; বলা হতো—‘তারকাদের তারকা’। সিনেমার পর্দায় নতুন শিল্পী আনতে প্রযোজকদের উৎসাহিত করতে পারতেন। নতুনদের নিয়ে কাজ করতেন। দর্শকদের সামনে হাজির করতে অথবা পছন্দ করাতে কঠোর পরিশ্রম করতেন।

কখনো লোকসান হওয়ার ঝুঁকি নিতেন—সফলও হতেন। নতুনদের মধ্যে—সালমান শাহ, মৌসুমী, শাকিল খান, আগুন, ইরিন জামান খান এবং শাকিব খান উল্লেখযোগ্য। এক সময় চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামুর রহমানকে বলা হতো ‘তারকাদের তারকা’। যার হাত ধরে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন শবনম, শাবানা, শাবনাজ, শাবনূর, নাদিম, নাঈমসহ কত শিল্পী।

চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে ১৯৮৮ সালে ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’ সোহানের নির্মিত প্রথম সিনেমা। কিন্তু সাফল্য পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঁচ বছর। ১৯৯৩ সালে নির্মাণ করলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড ব্যানারে নির্মিত সিনেমাটি দর্শক মহলে সমাদৃত হলো। সফল পরিচালক হিসেবে সোহানুর রহমান স্বীকৃত পেল।

নতুন জুটি হয়ে সালমান শাহ এবং মৌসুমী দর্শক মনে তারকা শিল্পীর মর্যাদায় অপ্রত্যাশিত চমক সৃষ্টি করলো। আমরা জানি, কপিরাইট গল্পের সিনেমায় দর্শকদের প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী। পুনর্নির্মাণ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ-ধর্মী কাজ পরিচালকের জন্য। এই ধরনের প্রায় ছবিই দর্শক গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু সোহানুর রহমান নির্মিত কপিরাইট সিনেমা সব কয়টিই ছিল সফল।

আরও পড়ুন >>> সিনেমা হোক দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পালতোলা নাও

তার দেশীয় সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সিনেমার মানানসই পট-রূপক চিত্রকল্প প্রতিমা দর্শক মনে প্রবলভাবে নাড়া দিতে সমর্থ হয়। দেশীয় শিল্পীদের অনুপম অভিনয় বিন্যাস দর্শকদের মুগ্ধ করে। মন-প্রান্তরে দ্যোতনা সৃষ্টি করে। রসালুপ্ত দর্শক তৃপ্ত হয়। সোহানুর রহমানের পরিশ্রম সফল হয়। পরিচালক হিসেবে তার নামটিও তারকা খ্যাতি পায়। যখন তারকা খ্যাতি লাভ করে শিল্পী-কুশলীদের সম্মান অথবা প্রত্যাশা বেড়ে যায়, যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী সৃষ্টির কারিগর হিসেবে তার মন কেমন ছিল, এই প্রসঙ্গে তার জীবনের ঘটনাক্রমে মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধান আবশ্যিক একটি বিষয়। কোনো মানুষই স্বীয় অর্জিত সুনাম সম্মান হারাতে চায় না। উপার্জনের বাজার সংকটে কর্মক্ষেত্র থেকে হতে চায় না বিচ্যুত। অথবা সব হারিয়ে নিশ্চুপ থাকে না।

চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে ১৯৮৮ সালে ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’ সোহানের নির্মিত প্রথম সিনেমা। কিন্তু সাফল্য পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঁচ বছর। ১৯৯৩ সালে নির্মাণ করলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’....

সোহানুর রহমান সোহানের জীবনে সাফল্যের পাশে তার বিব্রত হওয়ার ঘটনা বর্ণিত হলেই পাঠক স্বচ্ছ ধারণা পাবে। আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড প্রযোজনা সংস্থায় তিনটি সিনেমা নির্মিত হলো। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বজন’ এবং ‘আমার ঘর আমার বেহেস্ত’। তিনটি সিনেমাই সুপার হিট হয়। আর সোহানুর রহমান হলেন ঢালিউড সিনেমার হিট পরিচালক।

তার সাফল্যে দৈনিক পত্রিকায় ক্রোড়পত্রও ছাপা হলো। মহা হইচই রব। তার প্রত্যাশা বেড়ে গেল। আনন্দমেলা সিনেমা প্রযোজনা সংস্থা থেকে আগামীতে আরও সিনেমা সে নির্মাণ করবে। কিন্তু তার প্রিয় প্রযোজনা সংস্থা নতুন পরিকল্পনা হাতে নিলো। ব্যবসায়িক কৌশলগত কারণে অথবা বৈচিত্র্যধর্মী চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দেওয়ার প্রয়াসে অন্য একজন পরিচালককে নির্বাচন করে আনন্দমেলা সিনেমা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। নতুন তারকা কুশলীদের অন্তর্ভুক্ত করল।

আরও পড়ুন >>> শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার 

সোহান সব জানতে পারল। আমরা তার রাগ, হতাশা, ক্ষোভ ও দ্রোহের কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করিনি। সবই যেন তার কাছে স্বাভাবিক ঘটনার অংশ হয়ে হাজির হয়েছে। সেই প্রোডাকশন হাউজে তার নিত্য যাওয়া আসা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পরিচালকের সঙ্গে হাস্য কলরবে আলাপ আলোচনায় মত্ত থাকা অন্য এক সোহানকে প্রত্যক্ষ করলাম। মানুষের মহানুভব আচরণ কেমন হতে পারে তা জানলাম।

মানবধর্মী গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান আজ আমাদের মাঝে নেই। আছে তার কৃতি-কাহিনি। আছে তাকে নিয়ে অফুরান চিত্তহরণ স্মৃতি এবং হাস্যকলরব, আরও থাকবে তার শিল্পী মনোচিন্তার সৌন্দর্য প্রকাশ।

যতদিন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থাকবে, ততদিন সবুজ তৃণলতা পুষ্প মঞ্জুরিত বাগান, দেয়ালে নকশা শোভিত টাইলসের বিন্যাস যা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি তথা আবদুল জব্বার খান পাঠাগারের অনিবার্য শিল্প অনুষঙ্গ হিসেবে সেইসব ক্ষেত্রে ফুটে উঠবে সোহানের অনিবার্য এক চিত্র!

তার জন্ম উত্তরবঙ্গের বেহুলা-লখিন্দরের জনপদ হিসেবে খ্যাত বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। শিক্ষাদীক্ষা লাভ ও বেড়ে ওঠা বৌদ্ধ বিহার অঞ্চল জয়পুরহাটে। তার মৃত্যু এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির মতো। স্ত্রীর মৃত্যুর বাইশ ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর কবরের পাশে অন্তিম শয়ানে শায়িত হয়; যা বিশ্বের নানান ট্র্যাজিক মহিমায় উন্নীত নাটক ও সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।

তা যেন চলচ্চিত্রেরই অন্য পিঠ—আরেক গল্প হয়ে হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে নির্মিত হবে আরেক মহাকাব্যিক বাস্তবতার ট্র্যাজিক চিত্রগাঁথা!

ড. মতিন রহমান ।। শিক্ষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা