শেখ রেহানা : বিস্ময়ে তাই জাগে
আমার প্রিয় ফুলের তালিকায় একটি অসাধারণ এবং অদ্ভুত ফুলের নাম আছে, বিচিত্রা ফুল। এই গাছে একই ডালে দুটো ভিন্ন রঙের ফুল ফোটে। একটির রঙ সাদা, আরেকটি বেগুনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা যেন সেই বিচিত্রা ফুলেদের মতো নিজস্ব রঙের আলোয় আলোকিত করে আমাদের চতুর্দিক। একজন রঙিন আলো ছড়ায়, আরেকজন শুভ্রতা। দুইজন মিলেমিশে মানুষকে অবাক বিস্ময়ে রেখে দুর্গম পথ হেঁটে চলেন সহজে, যেন কোনো বেদনার ভার নেই তাতে।
বিজ্ঞাপন
জাতির পিতার এক কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমাদের শেখের বেটি হাসুবুবু সম্পর্কে অনেক জানা যায়, তাকে নিয়ে লেখা হয় কিন্তু আরেক কন্যা সকলের ছোট আপা শেখ রেহানাকে নিয়ে তেমন কোনো বিশ্লেষণ ভিত্তিক লেখা খুব একটা চোখে পড়ে না।
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
আজ শেখ রেহানা, পরিবারে আদরের নাম মুন্নার জন্মদিন। তাকে দূর থেকেই দেখেছি মাত্র, সামনাসামনি কথা বলার মতো সুযোগ হয়নি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাবো বলে আজ লিখতে বসে মনে হলো, শেখ রেহানার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখার চেষ্টা করিনি কখনো। তা হলো, স্বচ্ছ বুদ্ধিদীপ্ত স্তব্ধতা।
ছোট আপা শেখ রেহানার এই সুন্দর দিকটি, তার সাথে ঘটে যাওয়া দুইটা বা তিনটা ঘটনা খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই জানা যায়।
একদম প্রথম থেকে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, ১৯৭৪ সালেই শেখ রেহানার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে জার্মানি ঘুরতে গিয়েছিলেন তিনি। সেইখান থেকে ফিরে আসবার পর ঘটা করে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
শেখ রেহানার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখার চেষ্টা করিনি কখনো। তা হলো, স্বচ্ছ বুদ্ধিদীপ্ত স্তব্ধতা...
১৯৭৫ সালে নিজ পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার পর দুইবোনের আর সেই সময়ে দেশে ফেরা হয়নি। পরবর্তীতে দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান দুই বোন। কিছুদিন পর শেখ রেহানা সেইখান থেকে তাদের খোকা চাচার কাছে লন্ডনে এসে বসবাস শুরু করেন।
শেখ রেহানার বিয়ে সম্পন্ন হয় লন্ডনের কিলবার্নে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুখ দুঃখের সাথী, বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ড. শফিক সিদ্দিকের সাথে। শেখ হাসিনা দিল্লিতে অত্যন্ত সীমিত অর্থে জীবনযাপন করতেন এবং বাড়তি কোনো আয় না থাকায় টিকেট কাটার টাকা জোগাড় করতে পারেননি।
বিয়ের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপে পিএইচডি করতে আসা স্বামীর গবেষণার জায়গা সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির কাছে চলে আসেন এবং পিএইচডি চলাকালীন সময়ে সীমিত উপবৃত্তি দিয়েই টানাপোড়েনে তারা জীবনযাপন করেছেন। সাবলেট থেকেছেন। হিসাব করে চলেছেন। অথচ এর মাঝেও নিজ সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে একটুও কার্পণ্য করেননি।
আরও পড়ুন >>> অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ
পরিবারে আদরের মুন্না একদম একা তার নতুন জীবনে প্রবেশ করেন। বাবা মায়ের আশীর্বাদ, বোনের আনন্দ, ভাইদের আদর থেকে যোজন যোজন দূরে এক স্তব্ধ সময়ে একেবারে একা ড. সিদ্দিক হোসেনের হাত ধরেন। নিরহংকারী সহজ জীবনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। নিজে চাকরি করে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন, জীবনবোধের অর্থ হাতে কলমে শিখিয়েছেন।
আরেকটি ঘটনা বড্ড বেশি অদ্ভুত এবং একেবারে নীরব। ২০০১ সালে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানাকে ঢাকার ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং তিনি তা সরকারি কোটেশন অনুযায়ী ক্রয় করেন।
২০০৮ সালের বাংলাদেশের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই শেখ রেহানা আবারও যুক্তরাজ্যে ফিরে যান।
পরবর্তীতে ২০০৫ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তার বাড়ি নিয়ে নেয়। এবং তা ধানমন্ডি থানা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বাড়ির অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য ২০০৬ সালে আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে বাড়িটি আর ফেরত নেবেন না, এই মর্মে আবেদন করেন। এবং সরকারকে তাদের কাজের জন্য উৎসর্গ করেন।
তাছাড়া আরও গভীরে গেলে জানা যায় যে, ২০০৭-২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের জরুরি অবস্থা চলাকালে শেখ হাসিনা গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় শেখ রেহানা তার বড় বোন শেখ হাসিনার হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের হাল ধরেন।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
২০০৮ সালের বাংলাদেশের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই শেখ রেহানা আবারও যুক্তরাজ্যে ফিরে যান। স্তব্ধ এবং স্বচ্ছ নির্মোহের আরেকটি উদাহরণ।
অল্প অল্প করে হলেও যতটা জানতে পেরেছি তারচেয়েও বেশি মুগ্ধতা ভর করেছে মুন্নার ওপর। নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র বোন শেখ হাসিনাকে এত নীরব কঠিন ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছেন, যা জানতে না চাইলে তাকে চেনা যায় না। তার মতো দৃঢ় ব্যক্তিত্ব অথচ নিভৃতচারী মানুষ আজকাল হাতেগোনা দেখা যায়।
আজকে তার জন্মদিন, আমার শুভ্র বিচিত্রা ফুলের জন্য অযুত নিযুত ভালোবাসা।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা