ছবি : সংগৃহীত

সরকারের এই মেয়াদের সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, নির্বাচনের খুব বেশি বাকি নেই। নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে তখন যেকোনো দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়ার কথা। আমাদের দেশে সরকারি দল আওয়ামী লীগ দৃশ্যতই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে, কয়েকদিন ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের সব নেতারাই তাদের বক্তৃতায় নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ওদের জোট এবং পরোক্ষ মিত্ররা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলকেই নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই রকম দেখা যাচ্ছে না।

বিএনপি, বিএনপির জোট, এবং বিএনপির সাথে অন্য বেশকিছু ছোট ছোট দল মিলে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে আছে। সিপিবি, বাসদ এবং ওদের বাম গণতান্ত্রিক জোট, ওরাও ওদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে একইরকম আন্দোলনে আছে। সরকারি দল ও জোট এবং ওদের সাথে জাতীয় পার্টি এরা ছাড়া বাকি প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে বিদ্যমান কাঠামোতে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে এরা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।

ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া খুবই জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা সিপিবি-বাসদের তদারকি সরকার বা অন্য কোনো প্রকারের একটা ফর্মুলা যদি কেউ দিতে পারেন তাও বিবেচনা করে গ্রহণযোগ্য নিয়মের ব্যাপারে যদি সকলে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারেন তাহলে নিতান্ত খারাপ হয় না।

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

যদিও এইরকম নির্বাচন এলেই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা ছেড়ে অনির্বাচিত কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কেবল নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য, এই ব্যাপারটার মধ্যেই অন্তর্নিহিত একটা অগণতান্ত্রিক ও বিরাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য থেকেই যায়। নীতিগতভাবে একটি সরকারের যখন মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, পরবর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে যেটুকু সময় লাগে সেই সময়টাতে পূর্ববর্তী সরকারের ভূমিকা এমনিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়ে যায়। আদর্শিক ক্ষেত্রে এই সময়ের মধ্যে প্রশাসন থাকার কথা নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আর পূর্ববর্তী সরকার এই সময়ে কেবল দৈনন্দিন কার্যপরিচালনা ছাড়া আর কোনো কাজ করার কথা না বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা না।

এইরকম সুষ্ঠু নির্বাচন বা পছন্দমতো নির্বাচন করার জন্য পদ্ধতি নিয়ে ক্রমাগত মতভেদ, আন্দোলন, পাল্টা আন্দোলন, এইসব প্রশ্নের মীমাংসা এতদিনে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। সেই ফয়সালাটা আমরা অর্জন করতে পারিনি—ব্যর্থতা আমাদের সকলের, রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বড় দুইটি রাজনৈতিক জোটের তো বটেই। এই ব্যর্থতার ফলে আমাদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক আলোচনায় জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত আলোচনা একরকম অনুপস্থিত হয়ে গেছে।

কেবল নাগরিকদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক আলোচনাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এখন আর কোনো নীতি আদর্শ বা সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি, এইসব প্রায় বিলোপ হয়ে গেছে...

কেবল নাগরিকদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক আলোচনাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এখন আর কোনো নীতি আদর্শ বা সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি, এইসব প্রায় বিলোপ হয়ে গেছে। দলগুলো হয়েছে একেকটা পরিবারের মালিকানায়, কেবলই একেকটি দল বা গ্যাং যাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে যেনতেন প্রকারে দলের মালিক পরিবারটির জন্য ক্ষমতা বাগিয়ে নেওয়া। আর ক্ষমতা বাগানোর জন্যে এরা নিজেদের দলের মৌলিক যেসব নীতি একসময় ছিল, সেইগুলোর প্রশ্নেও আপস করে ফেলে।

এমনিতেও বড় দুইটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমাদের দেশে ক্ষমতা দখলের জন্য যতই পরস্পরের সাথে বৈরিতা থাকুক, রাষ্ট্রীয় নীতি আদর্শের প্রশ্নে ওদের মধ্যকার বিভেদ অনেকাংশেই কমে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী দলগুলোর মতো বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ ওদের নীতি পরিবর্তন করে বাজার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি 

দুনিয়াব্যাপী নব্যউদারনীতিবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের ফলে দেশের অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখন মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। প্রয়োগের ক্ষেত্রে হয়তো কেউ একটু দক্ষ, কেউ কম দক্ষ, কিন্তু দুই দলই বাজার অর্থনীতির বাইরে যেতে রাজি না।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও, একসময় যাদের বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যেত, ওরাও অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে এখন আর মুখ ফুটে সমাজতন্ত্রের কথা কেউ বলে না। অন্যভাবে বললে, সিপিবি-বাসদ ও অন্য দুই একটি ছোট দল ছাড়া দেশের মধ্যে একরকম ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে দেশে বাজার অর্থনীতিই থাকবে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি, যেটা ছিল আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি, প্রশ্নটিও যেন পেছনে পড়ে গেছে।

এটার নানাপ্রকার প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে, তার মধ্যে একটা তো হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো বিরাজনৈতিক একেকটা দলে পরিণত হয়েছে। এটার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে শাস্তিপ্রাপ্ত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর শোক প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকার ফলে ছাত্ররা প্রতিদিন আরও বেশি করে রাজনিতিবিমুখ হতে থাকবে আর ওদের চিন্তার জগতে এই আদর্শগত শূন্যতা পূরণ করবে সাম্প্রদায়িকতা।

সাধারণভাবে ছাত্রদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা এমনিতেই বাড়ছে দেড় দশক বা তারচেয়ে কিছুটা বেশি সময় ধরে। এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী দলটির ছাত্র সংগঠনের সদস্যরাও এখন আর সাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করার সাথে ওদের দলের একসময়ের মৌলিক নীতি অসাম্প্রদায়িকতার সাথে কোনো সংঘর্ষ বা সংঘাত দেখতে পায় না। আর সাধারণভাবে দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে তা বলা তো বাহুল্য মাত্র।

আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে যে, এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে চরম সাম্প্রদায়িক যেসব গ্রুপ দেশে বিদ্যমান আছে, যেমন হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো, তারা সুযোগটা গ্রহণ করবে এবং চেষ্টা করবে যতটুকু পারা যায় রাজনৈতিক ক্ষেত্র দখল করা যায় সেইটা করে নিতে। ইতিমধ্যে ওরা সরকারের সাথে নানারকম সমঝোতা ইত্যাদি করে একটা অবস্থান তৈরি করেছে। এখন যেহেতু নির্বাচন চলে আসছে, এখন ওরা নির্বাচনে সমর্থন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে।

আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি 

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম ওদের কমিটি পুনর্গঠন করেছে। পত্রিকান্তরে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে হেফাজতে ইসলাম এখন ওদের পুরনো ১৩ দফা বা তার চেয়েও কট্টর কোনো দাবিনামা সামনে নিয়ে আসবে এবং বড় দুই রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে সেইসব দাবির পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্যে। আর সেটা হবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, নারী ও সব সেক্যুলার লিবারেল নাগরিকের জন্য বড় দুঃসংবাদ। এমনকি আশঙ্কা করা যায় যে বাংলাদেশ তার উদারনৈতিক চরিত্রও হয়তো হারিয়ে ফেলবে অনেকখানি।

আরেকটা বড় প্রভাব হতে পারে যে আমাদের তরুণদের মধ্যে বা আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটবে। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকার ফলে ছাত্ররা প্রতিদিন আরও বেশি করে রাজনিতিবিমুখ হতে থাকবে আর ওদের চিন্তার জগতে এই আদর্শগত শূন্যতা পূরণ করবে সাম্প্রদায়িকতা।

নির্বাচন আর ক্ষমতা দখলের কায়দাকানুন নিয়ে কলহ করতে করতে যখন রাজনৈতিক দলগুলো একেকটা নীতিহীন, আদর্শহীন ও রাজনীতিহীন বিরাজনৈতিক দলে পরিণত হতে থাকবে তখন ছোট ছেলেমেয়েরা বড় হতে থাকবে রাজনীতিবিমুখ নীতিহীন ও সাম্প্রদায়িক ফ্যান্টিক হিসেবে। সেইরকম ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যে মোটেই সুখকর হবে না।      

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট