সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : আপদ নাকি অবলম্বন?
ধরে নিন, আপনি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপক। আপনাকে সকাল সাতটায় সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে। এরজন্য সাধারণত ভোর ৫.৩০ মিনিটে অফিসের ট্রান্সপোর্ট আপনাকে নিতে আসবে। ঢাকায় সেইদিন প্রবল বৃষ্টি। জলমগ্ন পথ-ঘাট। কোনো অবস্থাতেই আপনি সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারলেন না।
স্টেশনেও এমন কেউ নেই যিনি সংবাদ উপস্থাপন করতে পারেন। এমন সময় সংবাদ প্রযোজক একটি নির্দিষ্ট অবয়ব (মানব কাঠামো) স্টুডিও’তে কৃত্রিমভাবে স্থাপন করে নির্দিষ্ট কমান্ডের মাধ্যমে নিউজের লিংকগুলো পাঠ করালেন। সেইখানে রক্ত-মাংসের কোনো উপস্থাপক-উপস্থাপিকা নেই। সংবাদ উপস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেল।
বিজ্ঞাপন
এআই সংবাদ উপস্থাপিকা
৯ জুলাই ২০২৩, ভারতের উড়িষ্যার একটি টেলিভিশন চ্যানেল ‘লিসা’ নামের একজন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা [Artificial intelligence (AI)]-এর টেলিভিশন সঞ্চালককে পর্দায় হাজির করে চতুর্দিকে হইচই ফেলে দেয়। ১৯ জুলাই ২০২৩, বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর ‘অপরাজিতা’ নামক এআই সংবাদ উপস্থাপিকার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়েছে। যাকে অভিহিত করা যায় সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ হিসেবে।
ভুয়া খবর
সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কীভাবে এলো সেই বিষয়ে আলোচনার জন্য একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। ২০১৬ সালে ইন্টারনেট পরিসর ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় খুবই আলোচিত শব্দ (Buzzword) ছিল ভুয়া খবর বা (Fake news)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘিরে এই ভুয়া খবর ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।
আরও পড়ুন >>> গণমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক
মার্কিন প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় ৬০ শতাংশের বেশি মার্কিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (মূলত টুইটার) মূল সংবাদ মাধ্যমে প্রবেশ করতো। আর প্রত্যেক মার্কিনি প্রতিদিন অন্তত এক বা একাধিক ভুয়া খবরে ক্লিক করতেন।
এছাড়া অন্যান্য গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর সাধারণত মূল, বস্তুনিষ্ঠ খবরের চেয়ে তিন গুণ দ্রুত ছড়ায়। যে প্রেক্ষাপটে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস (Pope Francis) ভুয়া খবরকে সমাজের জন্য এক ধরনের অসুস্থতা বলে উল্লেখ করেছিলেন। আর ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হয়ে হিলারি ক্লিনটন ভুয়া খবরকে অভিহিত করেছিলেন সমাজের জন্য ‘মহামারি’ (epidemic) হিসেবে।
২০১৬ সালেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। কিন্তু ভুয়া খবর ছিল এক নম্বরে আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি ছিল দ্বিতীয় সারিতে...
যাই হোক, এই অসুস্থতা বা মহামারি রোধ করার জন্য সেই সময় থেকেই নানা আলোচনা শুরু হয়। প্রযুক্তিবিদ, সামাজিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা এই ক্ষতি নিরসনে নতুন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। তাই বলা যায় ২০১৬ সালেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। কিন্তু ভুয়া খবর ছিল এক নম্বরে আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি ছিল দ্বিতীয় সারিতে।
২০১৬ সালে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে থাকলেও ২০২৩ সালে এসে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি। বর্তমান বিশ্বে এখন চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে। যে যুগে মানবিক জনবলের জায়গা দখল করে নেবে যন্ত্রের দক্ষ জনবল। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে মানুষের সংশ্লিষ্টতা কমে বাড়বে যন্ত্রের আধিপত্য। আর যেসব যন্ত্র হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগ্রাসন বা আধিপত্য সংবাদমাধ্যমেও চলে এসেছে। আসুন একটু জেনে নিই কীভাবে এর সূত্রপাত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূত্রপাত
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূত্রপাত নিয়ে বিশ্বখ্যাত গবেষণাপত্র প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম সেজ পাবলিকেশন্সে ২০১৯ সালে ‘A Brief History of Artificial Intelligence: On the Past, Present, and Future of Artificial Intelligence’-গবেষণা শিরোনামে একটি জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। যার লেখক মাইকেল হেইনলেয়িন (Michael Haenlein) ও এ্যান্ড্রেস কাপলান (Andreas Kaplan)। তারা তাতে তুলে ধরেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রযাত্রার ইতিবৃত্ত।
এই গবেষণা নিবন্ধে তারা দেখিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যাত্রা শুরু হয়েছিল মার্কিন কল্পকাহিনিকার আইজ্যাক অ্যাসিমভ (Isaac Asimov)-এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে। যদিও একই সময় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং (Alan Turing) একটি গণনা যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যার মাধ্যমে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বার্তা কোডকে বিশ্লেষণ করা হতো। তার আবিষ্কৃত এই যন্ত্রটি বেশ বড়, প্রায় এক টন ওজনের।
মানুষের কাজ যন্ত্র দিয়ে নির্ভুলভাবে করানোর এই চেষ্টা এরপরেও অব্যাহত রয়েছে। আমরা যদি বর্তমানের দিকে তাকায় তাহলে দেখতে পাবো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকের ফিডে প্রতিদিন পুরাতন বছরগুলোয় ঐদিন কী করা হয়েছিল তার বার্তা আসে।
আরও পড়ুন >>> অনলাইন সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ
আবার আপনি গুগলে যেকোনো পণ্য কেনার জন্য খোঁজ করার পর সেই পণ্যের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন আপনার ব্রাউজারে চলে আসে। সবকিছুই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ। সহজ করে বললে, আমরা প্রতিনিয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছি অনেকক্ষেত্রে, আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ব্যবসায়িক শিকারে পরিণত হচ্ছি।
সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
আবারও ফিরতে হয় সেজ পাবলিকেশন্সের কাছে। ২০১৯ সালে এই পাবলিকেশন্সের Journalism & Mass Communication Quarterly গবেষণা সংকলনে ‘Artificial Intelligence and Journalism’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। যার লেখক ছিলেন সেথ সি. লুইস (Seth C. Lewis)।
এই গবেষণা নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয় একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এআই-এর একাধিক সমস্যাপূর্ণ অর্থ রয়েছে। এর পরিধিও ব্যাপক। প্রযুক্তির এই শাখা ব্যবহার করে যেমন বড় পরিসরের তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে দ্রুত ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে ঠিক তেমনি এখানে মানুষের অংশগ্রহণ বা সংশ্লিষ্টতা কমে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
....সাংবাদিকতা হলো পরিপূর্ণ মানুষ সংশ্লিষ্ট পেশা। এখানে মানুষের বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ ও সর্বোপরি মানবিকতার চর্চা খুব জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হলে সাংবাদিকতার মতো সংবেদনশীল পেশায় নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
সেথ সি. লুইস অত্যন্ত আস্থার সাথে বলেছেন, সাংবাদিকতা হলো পরিপূর্ণ মানুষ সংশ্লিষ্ট পেশা। এখানে মানুষের বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ ও সর্বোপরি মানবিকতার চর্চা খুব জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হলে সাংবাদিকতার মতো সংবেদনশীল পেশায় নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
তবে সমস্যার সম্ভাবনা থাকলেও সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের চর্চা কিন্তু থেমে নেই। বরং চলতি বছরেই এইক্ষেত্রে নতুন সংযোজন হয়েছে। ২০ জুলাই টেক জায়ান্ট গুগল ‘জেনেসিস (GenesisAI)’ নামের নতুন একটি এআই টুল ব্যবহার শুরু করেছে। যার মাধ্যমে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউজ কর্পোরেশসনের মতো হাউজগুলো তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়াজাত করে নির্ভুলভাবে সংবাদ তৈরি করে।
একইসাথে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে ফ্যাক্ট চেকিং-এর ক্ষেত্রে। যা একটি ইতিবাচক দরজা খুলে দিয়েছে। উন্নত বিশ্বে গুগলের ‘জেনেসিস’, লিসা’ বা ‘অপরাজিতা’-এর আর্বিভাবে অনেক সাংবাদিকই শঙ্কায় রয়েছেন চাকরি নিয়ে। যদিও বিষয়টা এতটা সরল নয়।
আরও পড়ুন >>> বায়াস, বুলশিট, লাই : আস্থার সংকটে সংবাদমাধ্যম
প্রথমত বাংলাদেশে এআই-এর কার্যকর প্রচলন হতে এখনো অনেক পথ বাকি। একইসাথে এই প্রক্রিয়া জটিলও। পেছনে তাকালে দেখা যায়, যখন সাংবাদিকতায় Computer-Assisted Reporting: CAR-এর প্রচলন হয়েছিল তখন অনেকেইে বলেছিলেন, এই বুঝি সাংবাদিকতায় মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। আর মনে হয় নিউজরুমে মনুষ্য জনবল দরকার নেই। কিন্তু বিষয়টি আসলে তা হয়নি।
বরং এই কম্পিউটার মানুষের মেধাকে নতুন করে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে গণযোগাযোগ তাত্ত্বিক নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিডিথ ব্ররোসারড (Meredith Broussard) বলেছেন, সাংবাদিকতা হলো গভীরভাবে মানুষ নির্ভর একটি পেশা। এই পেশায় দক্ষ ও যোগ্য মানুষের প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু তাই বলে মানুষকে বিতাড়িত করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাংবাদিকতার পরিসরকে পুরোপুরি দখল করে নেবে তার সাথে একমত নন এই তাত্ত্বিক।
তাই এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাংবাদিকতায় নতুন অবলম্বন হতে পারে। যার মাধ্যমে আরও পেশাদার ও আধুনিক সাংবাদিকতা সম্ভব। দরকার প্রযুক্তি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়