খালি সরকারি ফ্ল্যাট ও শিক্ষার্থীর আবাসন সংকট
খালি পড়ে আছে ১৮০০ সরকারি ফ্ল্যাট। সমীক্ষা ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আবাসিক ভবন। চাহিদার বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি (প্রথম আলো, ১৬ নভেম্বর ২০২২)। প্রতিবেদনটি পুরোনো, কিন্তু তার বিপরীতে যে সংকটের কথা বলবো তা নতুন।
আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আজিমপুর, বেইলি রোড, তেজগাঁ, মিরপুরসহ রাজধানীর প্রাইম এলাকায় অসংখ্য বিলাসবহুল ভবন বা ফ্ল্যাট বানিয়েছে সরকার। আর এই দেশের যারা ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতে যারা এই দেশের হাল ধরতে প্রস্তুতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তাদের জন্য বসে পড়ার জন্য একটি টেবিলের ব্যবস্থা, পড়া শেষে ক্লান্ত হলে ঘুমানোর একটা বেড পর্যন্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
সরকারি কর্মকর্তারা কি এইসব দেখে না? তাদের লজ্জা লাগে না যে তাদের সন্তানদের পড়ার জন্য যেখানে টেবিল কিংবা ঘুমানোর জন্য একটা বেড পর্যন্ত নেই অথচ তাদের নিজেদের জন্য শত শত ফ্ল্যাট কেবল বানিয়েই চলেছে।
এত বড় অন্যায় সরকার কীভাবে করে? এই ১৮০০ ফ্ল্যাট আমাদের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দিলে কত ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পেত তা বলে বোঝাতে পারব না। বড় উপকার হতো।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক?
আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কি দেখে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি দেখে না? না তারা দেখে ঠিকই কিন্তু চোখে টিনের চশমা আর মুখে তালা মেরে রাখার জন্যই রাজনীতি করে।
তাদের কাজ হলো সরকারকে নিরাপত্তা দেওয়া, সরকারি দলের শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়লে তাদের নিতাপত্তা দেওয়া, সরকারের পক্ষে বিবৃতি দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষক সমিতি কি সরকারের কাছে ছাত্রদের তীব্র এই আবাসিক সংকট সমাধানের জন্য দাবি জানিয়ে কোনো বিবৃতি দিয়েছে, সংবাদ সম্মেলন করেছে? জোর দাবি জানিয়েছে?
বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা অন্য কেউ কি কখনো আমাদের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো দাবি জানিয়েছে? যারা ছাত্র রাজনীতি করে, সরকারি দলের ছাত্রনেতারা কি কখনো দাবি জানিয়েছে?
সরকারি কর্মকর্তারা কি এইসব দেখে না? তাদের লজ্জা লাগে না যে তাদের সন্তানদের পড়ার জন্য যেখানে টেবিল কিংবা ঘুমানোর জন্য একটা বেড পর্যন্ত নেই অথচ তাদের নিজেদের জন্য শত শত ফ্ল্যাট কেবল বানিয়েই চলেছে।
দাবি জানিয়ে যেন সরকারকে বিব্রত করা না হয় সেই জন্যই সরকার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনীতি ইঞ্জেক্ট করে। উপরন্তু আবাসিক সমস্যাকে ব্যবহার করে ছাত্রদের রাজনীতিতে নিয়োগ করাও একটি বড় উদ্দেশ্য।
শিক্ষার্থীরা যদি ভালো থাকে তাহলে তো তারা রাজনীতি করবে না। তখন তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার মানুষ পাবে কোথায়? ছাত্র শিক্ষকের কথা বাদ দিলাম। দেশে তো আরও অনেক মানুষ আছে। বাবা-মা কি কখনো দাঁড়িয়ে বলেছে আমাদের সন্তানরা এইভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে পারে না।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান
ছাত্রদের কাজ লেখাপড়া করা। তাদের ফাঁদে ফেলে বা জোর করে রাজনীতি করানো ঠিক না। কত ছাত্রদের ভবিষ্যৎ প্রতিবছর ধ্বংস হয় তার কোনো গবেষণা নেই। এই ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সেই গবেষণার ফল প্রকাশের পরিবেশ পর্যন্ত নেই এই দেশে। ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতি করে যদি তাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানের দাবি আদায় করতে না পারে কীসের জন্য এই রাজনীতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে প্রায় ৭ হাজার নতুন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসেছে। এদের বিশাল অংশ ঢাকার বাইরে মফস্বল বা গ্রাম থেকে এসেছে। যাদের ঢাকায় থাকার জায়গা নেই তাদের সবার ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট করে থাকার জায়গা কি ঠিক হয়েছে? তারা কোথায় থাকবে?
বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা অন্য কেউ কি কখনো আমাদের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো দাবি জানিয়েছে?
এই সময়টাই সবচেয়ে দুর্বল, তাই সারা পৃথিবীতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা আসার আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় কে, কোথায়, কত নম্বর রুমে থাকবে। দেশ নাকি অনেক উন্নত হয়েছে। দেশ থেকে পাচার করা টাকার অভাব নেই। অথচ যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাদেশ স্বাধীন করার পেছনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বস্তির মানুষের জীবন থেকেও খারাপভাবে থাকে, গেস্ট রুমে টর্চারের শিকার হয়।
ছাত্রদের ন্যূনতম চাহিদা হলো পড়তে পারার জন্য একটা টেবিল, ঘুমানোর জন্য একটা বিছানা আর কাপড় রাখার জন্য একটা ওয়ারড্রব। স্বাধীনতার এত বছর পরেও শিক্ষার্থীদের এই ন্যূনতম চাহিদাও পূরণ হলো না। তারপরেও আমরা বলব দেশ উন্নত হচ্ছে?
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেন উন্নত হচ্ছে না?
আপনাদের এই উন্নত দেশের ১ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যদি এইরকম করুণ অবস্থা হয় তাহলে বাকিদের কথা ভাবুন। ৭০০০ ছাত্রের একটা বড় অংশ গণরুমে থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের সাথে বিদেশের যেকোনো হলের ছাত্রাবাস তুলনা করলেই বোঝা যায় আমরা আসলে কোথায় আছি।
প্রথম বর্ষে আবাসিক সমস্যার কারণে কত ছাত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে তার কি কোনো খোঁজ কেউ রেখেছে? সিঙ্গাপুরের সেরা ধনীদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশি আছে। তারা কি আমাদের ছাত্রদের দুরবস্থা কমানোর কথা কোনোদিন ভেবেছে? কী করবে এত টাকা দিয়ে?
এদের নিয়ে আমাদের ছাত্রনেতাদের কোনো মাথাব্যথা আছে? ছাত্র রাজনীতি তো হওয়ার কথা ছাত্রদের কল্যাণের জন্য। নতুন যারা আসলো তাদের জন্য তাদের কোনো প্রোগ্রাম ছিল? হ্যাঁ আছে, এদের দুর্বলতা পুঁজি করে এদের ক্যাডার বানানোর অপেক্ষায় আছে, এদের গেস্ট রুমে এনে টর্চার করার অপেক্ষায় আছে, মিছিল ভারি করার অপেক্ষায় আছে। শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়