সর্বজনীন পেনশন স্কিম যেন টেনশনে রূপ না নেয়
দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের পেনশন কর্মসূচির আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ আগস্ট ২০২৩ সকাল ১০টায় সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। প্রাথমিকভাবে চারটি পেনশন কর্মসূচি—'প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা এবং প্রবাসী'-এর উদ্বোধন করেন। অন্য দুটি কর্মসূচি পরে চালু করা হবে বলে জানান।
উদ্বোধনের আগে ২৪ জানুয়ারি ২০২৩-এ জাতীয় সংসদে 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল–২০২৩' কণ্ঠ ভোটে পাস হয়। এর অধীনে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ 'জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ' গঠিত হয়। তারপর ১৪ আগস্ট ২০২৩-এ অর্থ মন্ত্রণালয় সর্বজনীন পেনশন বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে।
বিজ্ঞাপন
উন্নত ও টেকসই জাতি গঠনে নিঃসন্দেহে এটা ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বয়স্কদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে অন্তর্ভুক্তিকরণ একটি মানবিক সরকারেরই প্রতিফলন। সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা সূচক যে আরও উন্নত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নত বিশ্বে এই ধরনের পেনশন কর্মসূচি অনেক আগেই কার্যকর করা হয়েছে। ভারতেও এই কর্মসূচি বিদ্যমান। অবশেষে, আমাদের দেশে এখন তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো।
আরও পড়ুন >>> সর্বজনীন পেনশন স্কিম : কল্যাণ রাষ্ট্রের পথে বাংলাদেশ
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে যে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটি। ২০৩১ সালের মধ্যে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ২ কোটিরও বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এই সংখ্যা হবে প্রায় ৩ দশমিক ৬ কোটি।
১৯৭৪ সালেও বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৪ বছর। জনস্বাস্থ্যের উন্নতি, জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি এবং খাবারের প্রাপ্যতায় মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে।
একদিকে গড় আয়ু বাড়ছে, অন্যদিকে প্রজনন হার কমার কারণে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। বার্ধক্যজনিত কারণে তারা যেন তার পরিবার বা রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়; কিংবা তারা কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বোধ না করে; তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বয়স্কদের জন্য নিরাপদ ও নির্ভরতার শেষ অবলম্বন হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাই, ক্রমান্বয়ে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে এর আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাও বিশেষ বিবেচনায় পেনশনভুক্ত হতে পারবে বলে পেনশন আইনে উল্লেখ করা হলেও কী বিশেষ বিবেচনায় এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে, সেই ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই।
১৮ থেকে ৫০ বছরের জাতীয় পরিচয় পত্রধারী ব্যক্তি পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাও বিশেষ বিবেচনায় পেনশনভুক্ত হতে পারবে বলে পেনশন আইনে উল্লেখ করা হলেও কী বিশেষ বিবেচনায় এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে, সেই ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। তবে, স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে চাঁদা প্রদানকারী যে বয়সে উপনীত হবে সেই বয়স থেকে আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হবে।
সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের 'প্রগতি স্কিম" বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য। এই স্কিমের ৫০ শতাংশ চাঁদা চাকরিজীবীরা ও বাকি ৫০ শতাংশ চাঁদা মালিক পক্ষ বহন করবে। কোনো প্রতিষ্ঠান এই স্কিমে অংশ গ্রহণ করতে না চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নিজ উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।
আরও পড়ুন >>> সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
'সুরক্ষা স্কিম' রিকশাচালক, শ্রমিক, কুমোর, কামার, জেলে, তাঁতি এবং অন্যান্য স্ব-কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য। 'সমতা স্কিম' নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অর্থাৎ যাদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম। এই স্কিমের মাসিক চাঁদার অর্ধেক বহন করবে সরকার।
'প্রবাসী স্কিম' প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। যদিও তারা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দেবে, তবে মেয়াদ পূর্তিতে তারা দেশীয় মুদ্রায় পেনশন পাবে। সমতা স্কিম ছাড়া অন্য স্কিমগুলোয় সরকারের অবদানের পরিমাণ পরিষ্কার নয়।
একজন পেনশনার ৬০ বছর বয়সে পেনশন পেতে শুরু করবে এবং আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবে। তবে, যদি কেউ ৭৫ বছরের আগে মারা যায়, তবে পেনশনারের নমিনি অবশিষ্ট সময় কালের অর্থাৎ মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবে।
পেনশন স্কিমের ১০ বছরের আগে কেউ মারা গেলে তার মনোনীত ব্যক্তি লাভসহ জমাকৃত অর্থ ফেরত পাবে। তবে, কত হারে লাভ পাবে সেটা এখনো উল্লেখ করা হয়নি। পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশনের চাঁদা আয়কর মুক্ত হবে। তাছাড়া, চাঁদা দাতার আবেদনের প্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। স্কিমের ভিন্নতায় চাঁদার হারও ভিন্নতর রাখা হয়েছে।
চাঁদা প্রদানের পরিমাণ ও সময় ধাপের ভিন্নতায় পেনশন সুবিধা পাওয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন—সুরক্ষা স্কিমে একজন ব্যক্তি ১, ২, ৩, বা ৫ হাজার টাকার মাসিক কিস্তির যেকোনো একটি স্কিম ১০, ১৫, ২০, ২৫, ৩০, ৩৫, ৪০ বা ৪২ বছরের জন্য যেকোনো একটি গ্রহণ করতে পারে।
একজন চাঁদা দাতা মাসিক ১ হাজার টাকা করে যদি ১০ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চাঁদা প্রদান করে তাহলে ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন ১,৫৩০ টাকা মাসিক পেনশন সুবিধা পাবে। আবার, ওই ব্যক্তিই যদি সমপরিমাণ মাসিক চাঁদা ৪২ বছর পর্যন্ত প্রদান করে তাহলে ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন ৩৪,৪৬৫ টাকা মাসিক পেনশন সুবিধা পাবে।
আরও পড়ুন >>> সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি!
পেনশন ফান্ড হচ্ছে একটি বার্ষিক বৃত্তি। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ফান্ডে বিনিয়োগ অন্যান্য সহজলভ্য সুযোগগুলো থেকে লাভজনক কি না তা বিনিয়োগের আগে অবশ্যই চাঁদা দাতারা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে নেবে। তবে, আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কর্মসূচিতে নিট বর্তমান মূল্য (NPV) ধনাত্মক তাই শুধু বিনিয়োগের জন্য বিবেচিত হওয়া উচিত।
কোনো বিনিয়োগের নিট বর্তমান মূল্য বের করার ক্ষেত্রে সময় ও বাট্টার হার নির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই হারের তারতম্যের কারণে ফলাফল ভিন্নতর হতে পারে। যেহেতু আমাদের গড় আয়ু ৭৪ বছরের কাছাকাছি; তাই এই গণনায় পেনশন প্রাপ্তির গড় সময় (৭৫-৬০) ১৫ বছর ধরা হয়েছে। তাছাড়া, বর্তমানে একজন বিনিয়োগকারী ডাকঘর সঞ্চয় হিসাবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা করলে শতকরা ৭.৫ টাকা হারে সুদ পায়।
সরকারের এই কর্মসূচির সফলতা নির্ভর করবে জনগণের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। কেননা, সাধারণ জনগণ এখনো বিশ্বাস করে যে, সরকারি কর্মসূচিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি মানেই আইনি জটিলতার মারপ্যাঁচ।
কাজেই, এই সুদের হারকে বাট্টার হার ধরে যদি আমরা সুরক্ষা স্কিমের প্রতিটি ধাপে নিট বর্তমান মূল্য বের করি তাহলে আমরা দেখব যে, ১০ ও ১৫ বছরের ধাপ ছাড়া প্রতিটি ধাপেই নিট বর্তমান মূল্য ধনাত্মক অর্থাৎ বিনিয়োগ লাভজনক। যেহেতু, ১০ ও ১৫ বছরের ধাপে নিট বর্তমান মূল্য ঋণাত্মক সেইক্ষেত্রে এই দুটি ধাপে বিনিয়োগ লাভজনক নয়। তবে, সামাজিক বিনিয়োগ কর্মসূচিতে মুনাফার বিষয় ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য যে, এই গণনায় বাট্টার হার নির্ধারণে মুদ্রাস্ফীতির হারকে সমন্বয় করা হয়নি। ভবিষ্যৎ মুদ্রাস্ফীতির হার সমন্বয় করা হলে ফলাফল হয়তো ভিন্নতর হবে। 'ট্রেডিং ইকোনোমিকস'-এর দেওয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির গড় হার ৩০ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছিল ৬.৪৪ শতাংশ। ভবিষ্যতেও এই গড় হার কমার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া, সুদূর ভবিষ্যতে টাকার মানের আরও অবমূল্যায়নের সম্ভাবনা তো রয়েই গেছে।
ভবিষ্যতে পেনশনারদের প্রাপ্য পেনশন সুবিধা প্রদান ছাড়াও কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ও অন্যান্য খরচ পরিচালনার জন্য কর্তৃপক্ষ পেনশন তহবিল কম ঝুঁকিপূর্ণ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করবে। তবে, তহবিল ব্যবস্থাপনা কমিটি দক্ষ ও গতিশীল না হলে বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কম ঝুঁকিপূর্ণ লাভজনক বিনিয়োগের মুনাফা দিয়ে এসব ব্যয়ভার সঠিকভাবে বহন করা সম্ভব কি না তা ভবিষ্যৎ বলবে। যদিও, পেনশন আইনের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে।
আরও পড়ুন >>> অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?
সর্বোপরি, সরকারের এই কর্মসূচির সফলতা নির্ভর করবে জনগণের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। কেননা, সাধারণ জনগণ এখনো বিশ্বাস করে যে, সরকারি কর্মসূচিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি মানেই আইনি জটিলতার মারপ্যাঁচ। পেনশনের টাকা পেতে শেষ বয়সে তাকে কিংবা তার নমিনিকে বাড়তি কোনো ঝামেলা বা পরোক্ষ কোনো খরচ বহন করতে হবে কি না তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা হলো এই যে,পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ফ্ল্যাট ক্রয় ঋণ প্রকল্পে সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ঋণের সুদে নির্দিষ্ট হারে ভর্তুকির অনুমোদন পেতে আবেদনের পর এক বছরের অধিক সময় লেগেছে। কাজেই, সর্বজনীন পেনশনের স্বতঃস্ফূর্ত সর্বজনীনতায় পেনশন কর্তৃপক্ষকে তাদের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাতে হবে সবার আগে। অন্যথায়, সরকারের এই পেনশন স্কিম নিয়ে টেনশন থেকেই যাবে।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়