ছবি : সংগৃহীত

সমস্যা বা সংকট থাকবেই। তবে তা নিরসনের চেষ্টা করলে সমাধান আসে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে ছয় বছর আগে তার সমাধান নিয়ে কোনো আশার আলো দেখছি না। বরং সময়ের সাথে তা বড় হচ্ছে, বাংলাদেশ পেঁচিয়ে যাচ্ছে লতাপাতায়।

১২ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়াটাই বিশাল চাপ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের জন্য এটি 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। বাংলাদেশের চেষ্টা আছে। গেল ছয় বছরে অনেক উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু একমাত্র স্থায়ী সমাধান প্রত্যাবাসন এখনো শুরুই হয়নি।

মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে আসা ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এমন মহানুভবতা আর কোনো দেশ দেখায়নি। মানবাধিকার নিয়ে সারা বিশ্ব কথা বলছে। বিশ্ব মোড়লরা দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সম্পর্কের পূর্বশর্ত হিসেবে মানবাধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ বাংলাদেশের এই সংকটে তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে দেখি না আমরা।

আরও পড়ুন >>> সীমান্তে গোলাবর্ষণ, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী দল ও আমাদের করণীয়

বিশ্ব আজ নানা সংকটে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর অভিঘাত সামলাতে হিমশিম অবস্থা। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ছিল আগে থেকেই। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অস্থির করে ফেলেছে পুরো বিশ্বকে। এই পরিস্থিতিতে হয়তো অনেক দেশের কাছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার এই সংকট অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা সংকট কয়েক দশকের সমস্যা। আগেও এর সমাধান হয়নি। সর্বশেষ বড় অনুপ্রবেশের পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সমাধানের কোনো স্থায়ী পথ তৈরি হয়নি এখনো।

রোহিঙ্গা সংকট কয়েক দশকের সমস্যা। আগেও এর সমাধান হয়নি। সর্বশেষ বড় অনুপ্রবেশের পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সমাধানের কোনো স্থায়ী পথ তৈরি হয়নি এখনো।

রাখাইনে সেনা অভিযানের পর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে। এরপর কয়েকটি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় তারা। আগের চার লাখ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের সাথে যোগ হয় আরও সাত লাখ। ছয় বছরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সেই বছরের শেষ দিকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করে মিয়ানমার। তবে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করতেই নানা প্রতিবন্ধকতায় আটকে যায়। ২০১৯ সালে এসে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু রাখাইনের নিরাপত্তা সংকট বিবেচনায় নিজ দেশে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

এরপর করোনা মহামারি শুরু হয়। প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শুরুতে ক্ষমতার পালা বদল ঘটে। অং সান সু চি’র সরকারকে সরিয়ে আবারও ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।

আলোচনা চালিয়ে যায় বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে দেন দরবার চলতে থাকে। ২০২১ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারসহ বিভিন্ন পক্ষ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি। ফলে থমকে গেছে পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনও।

আরও পড়ুন >>> সীমান্ত সংকট ও মিয়ানমারের সামরিকায়ন : কী করছে বিশ্ব? 

সম্প্রতি এই বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনে কারও বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়। এই উদ্যোগ বড় আকারে প্রত্যাবাসনের পথ সুগম করবে। চূড়ান্ত প্রত্যাবাসনের আগে চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে সহায়তা করবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ সৃষ্টি হলে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরতে চায় রোহিঙ্গারা। জানান, পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সর্বদা একটি ‘মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায়’ প্রত্যাবর্তনের জন্য তার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখবে। বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টাকে ক্ষুণ্ন না করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের আশ্রয় দিয়ে বছরের পর বছর শরণার্থী শিবির পরিচালনা করতে গিয়ে বহুমুখী সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বিপন্ন মানুষদের পুশ-ব্যাক করার চেষ্টা করেনি। এজন্য বিশাল আর্থ-সামাজিক চাপও সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তারপরও নিয়মতান্ত্রিক প্রত্যাবাসনের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা অপ্রতুল। অসহযোগিতাও আছে।

বিশাল এই সংকট নিরসনে মিয়ানমারের সদিচ্ছা নেই। নিশ্চিতভাবে এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থা, প্রতিবেশী ও উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতার বিকল্প নেই। সেইখানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না। ফলে ১২ লাখ মানুষ ও একটি দেশের সংকট মহা সংকটে রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের জেলা কক্সবাজারের দুটি উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম সামাজিক সংকট। আইনশৃঙ্খলা হুমকিতে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলো ঘিরে মাদক, অপহরণ, অস্ত্র, মানব পাচারের সক্রিয় চক্র গড়ে উঠেছে।

ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ চলছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আশ্রয় শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে আতঙ্কের জনপদ। সন্ত্রাসের পাশাপাশি এই অঞ্চল ঘিরে জঙ্গিবাদ উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এত বছরে যদি প্রত্যাবাসন শুরুই করা না যায় তবে সামনে আরও ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য।

ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ চলছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আশ্রয় শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে আতঙ্কের জনপদ। সন্ত্রাসের পাশাপাশি এই অঞ্চল ঘিরে জঙ্গিবাদ উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে।

মনে পড়ছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কথা। টেকসই এই দ্বীপকে আরও সুরক্ষিত করা হয়েছিল। নির্মাণ করা হয়েছে এক লাখ মানুষের আধুনিক মজবুত আবাসন ব্যবস্থা। নিশ্চিত করা হয়েছে বেঁচে থাকার সব ধরনের উপকরণ।

উপকূল ও দ্বীপ জনপদ সম্পর্কে কমবেশি ধারণা থেকে সহজেই বুঝেছিলাম এই আশ্রয় কেন্দ্র কতটা মজবুত ও আধুনিক করে বানানো। অথচ আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যম এই দ্বীপকে মানুষ বসবাসের অনুপযোগী বলে সংবাদ করল। পরে জেনেছি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এই স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে।

আরও পড়ুন >>> রোহিঙ্গা : কূটনীতির সুফল মিলবে কবে? 

রোহিঙ্গা শিবির থেকে তাদের কমিউনিটি লিডাররা বারবার দেখে গেছেন। তারা ক্যাম্পে ফিরে ভাসানচরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অনেকেই স্থানান্তরে আগ্রহী হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় বিভিন্ন পক্ষ। ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসী সশস্ত্র গ্রুপগুলোও ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করে।

যারা স্থানান্তরে আগ্রহী হয়ে তালিকায় নাম লেখায় তাদেরও হুমকি-ধামকি দেয় সেই সন্ত্রাসীরা। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া নষ্ট করার সব অপচেষ্টা ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। তবে তার জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। ধারণা করি, দেশের অভ্যন্তরে স্থানান্তরই যেখানে এত ঝক্কির হয়, তবে প্রত্যাবাসন কতটা কঠিন!

সামনে অনেক কাজ। কিন্তু একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরে বেড়ায়, আজকে যদি মিয়ানমার এই ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজিও হয় তার জন্য বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?

মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন