ছবি : সংগৃহীত

‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ এই পঙ্‌ক্তি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। স্নেহাস্পদ প্রিয় সহকর্মী যুগান্তরের সিনিয়র প্রতিবেদক হাবিবুর রহমান খানের অকাল প্রয়াণে এই পঙ্‌ক্তির কথা বারবার মনে পড়ছে, যদিও কোনো কোনো মৃত্যু আমাদের মনকে এতটাই আলোড়িত করে যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

এভাবে, এমন করে, এমন অসময়ে মাত্র ৪২ বছরে, সবেমাত্র তারুণ্য পেরিয়ে-হাবিব আমাদের কাঁদিয়ে চলে যাবে; তা আমার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। ২২ আগস্ট ২০২৩, বিকালবেলা যখন বার্তাকক্ষে সহকর্মীরা কাজে তৎপর হয়ে উঠছে মাত্র, ঠিক তখনই হাবিবের মৃত্যুখবর জানিয়ে আসা ফোনটি ছিল অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়।

আমরা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খবরটি শুনে হুহু করে কান্না শুরু করে সহকর্মী লাবলুসহ আরও কয়েকজন। আর পুরো বার্তাকক্ষ যাকে বলে হতবিহ্বল অবস্থা।

আরও পড়ুন >>> গণমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক

মৃত্যুসংবাদের ফোনটি প্রথম রিসিভ করেছেন আহমেদ দীপু। আমি তাকে বললাম, ‘আবার ফোন করো, কনফার্ম হও; কোনো ভুল হচ্ছে হয়তো।’ সত্যিকার অর্থে, হাবিবের মৃত্যুর ‘সংবাদটি সত্য’-তা বিশ্বাসে আসতে আমাদের প্রায় ১০-১৫ মিনিট সময় লাগল।

এক অবর্ণনীয় শোকের অনুভূতিতে নীরব হয়ে ওঠে বার্তাকক্ষ। শোকে মানুষ আহত হয় ‘কেমন’, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কারণ প্রতিদিনই কিছু না কিছু মৃত্যুসংবাদ আমরা ছাপি পত্রিকায়, তাতে কমবেশি ‘শোকাহত’ শব্দটি থাকেই। কিন্তু শোক কীভাবে বেদনাহত করে সতীর্থ, স্বজনদেরও, তা যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিয়ে দিল হাবিব। অনুজপ্রতিম হাবিব।

২.

যুগান্তরের দীর্ঘ দুই যুগ পেরোনোর এই যাত্রায় আমরা আমাদের অনেক প্রিয়জনের প্রয়াণের সম্মুখীন হয়েছি। আমার অগ্রজ শ্রদ্ধাস্পদ দৈনিক যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বত্বাধিকারী, আমাদের প্রাণপ্রিয় চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম; শ্রদ্ধাস্পদ প্রিয় সম্পাদক আমার গুরু গোলাম সারওয়ার; সর্বজনমান্য প্রবীণ সাংবাদিক, সম্পাদক এবিএম মূসা; অগ্রজতুল্য দেশের কিংবদন্তি ছড়াকার রফিকুল হক (দাদুভাই)-তাদের হারিয়ে আমরা অভিভাবক হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত।

যুগান্তরের দুই যুগ পেরিয়ে এই যাত্রায় অনেক সহকর্মীদের হারিয়েছি আমরা। হারিয়েছি সহকর্মী রাশীদুন নবী বাবুকে, হারিয়েছি যুগান্তরের রাজশাহীর সাবেক ব্যুরোপ্রধান বুলবুল চৌধুরীকে, স্নেহাস্পদ আহমেদ ফরুক হাসানকে, হারিয়েছি মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুকে, শফিউল আলম রাজাকে এবং আরও অনেক সহকর্মীকে। করোনা মহামারির সময়ও চলে গেছেন আমাদের কয়েকজন সহকর্মী।

আরও পড়ুন >>> অনলাইন সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ

সত্যিকার অর্থে জন্মের পরমুহূর্ত থেকেই শুরু হয় আমাদের মৃত্যুর গন্তব্যে পৌঁছানোর অভিযাত্রা। আমরা কেউই এই পথপরিক্রমার বাইরে নই। তবুও কিছু কিছু মৃত্যু, সত্যি এভাবে থমকে দেয়, বিষণ্ন করে দেয় আমাদের।

৩.

বার্তাকক্ষে আমরা প্রতিদিন এমন উৎকর্ণ হয়ে বাঁচি যে নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে যাই—আমাদের পুরো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে সংবাদ, সংবাদসংশ্লিষ্ট সব উপাদান। যেন আমরা রোবটে পরিণত হই-বার্তাকক্ষের সবাই; খবরের পেছনের খবর উদ্ঘাটনে আমরা এতটাই মনোযোগী হই, মৃত্যুর ক্ষণগণনার অবকাশ আমাদের কোথায়? আমি এই কঠিন বাস্তবতার বিষয়টি উপলব্ধি করছি হাবিবের এমন অকালে, অসময়ে চলে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে।

আমি প্রতিদিন অফিস থেকে কাজ শেষ করে বেরোনোর সময় হাবিব ওর ডেস্ক থেকে উঠে আসত, আমি ওর পিঠে স্পর্শ করে অফিস থেকে বের হতাম; যেন একটা স্বস্তি নিয়ে যে, বার্তাকক্ষে সর্বশেষ বার্তাটাও ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না, পরদিন যুগান্তরের পাঠক সর্বশেষ সংবাদটিও মিস করবেন না। যেন এইটাই আমাদের একমাত্র সম্পর্ক, অলিখিত প্রতিশ্রুতি যুগান্তরের প্রতি, যুগান্তরের পাঠকদের প্রতি, সব সহকর্মীর প্রতি।

৪.

কাজের প্রতি হাবিবের ডেডিকেশন কতটা গভীর, তা যেকোনো পাঠকই ওর সর্বশেষ রিপোর্টটি পড়লেই উপলব্ধি করবেন। যাকে বলে, ইনডেপ্থ রিপোর্টিং, সেটা ও সব সময় করত। ফলে ওর মৃত্যুতে শুধু যুগান্তরের সহকর্মীরাই নন, অন্য গণমাধ্যমের সহকর্মী, রিপোর্টার্স ইউনিটি, প্রেস ক্লাবসহ ওকে যারা চেনেন-বলতে পারি, তারা সবাই শোকাহত হয়েছেন। এটাই একজন প্রকৃত সংবাদকর্মীর সার্থকতা তার কাজের, তার জীবনের।

হাবিবকে যারা চেনেন, তারা জানেন ওর বন্ধুবাৎসল্যের গুণটির কথা। অনায়াসে হাবিব সম্পর্কের সেতু তৈরি করতে পারত ওর সহজাত সরলতার আশীর্বাদে। সম্পর্কের সেই স্নিগ্ধতার মায়া কাটিয়ে এমন অকালে, অসময়ে হাবিবের চলে যাওয়া আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।

আরও পড়ুন >>> বায়াস, বুলশিট, লাই : আস্থার সংকটে সংবাদমাধ্যম 

লেখার শুরুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে পঙ্‌ক্তিটির কথা উল্লেখ করেছি, তা এই কারণে—প্রতিদিন হাবিব ওর ডেস্ক থেকে উঠে এসে আমাকে এগিয়ে দিত, আমি ওর পিঠে স্নেহস্পর্শও বুলিয়ে দিতাম; কিন্তু ওকে কখনোই প্রশ্ন করিনি তোমার শরীর কেমন?

এমন প্রশ্ন মনে উদ্রেকই হয়নি কখনো। কারণ এমনই রোবটের মতো আমাদের বার্তাকক্ষের জীবন! এজন্যই হাবিবের মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দিচ্ছে যেন। কোনোদিন আর পিঠ স্পর্শ করা হবে না। কোনোদিন ও আর ডাকবে না ‘সাইফুল ভাই’।

আমিও ডাকতে পারব না ‘হাবিব’। এইসবের অনেক ঊর্ধ্বে এখন ও। মহাকালের অনন্তযাত্রায় হাবিব এখন স্মৃতির জগতে অনির্বাণ হয়ে জ্বলবে। হাবিব তুমি ভালো থাকো।

সাইফুল আলম ।। সম্পাদক, যুগান্তর; সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব