ধারদেনায়ও চলছে না সংসার!
মানুষ কষ্টে আছে, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, ধারদেনায়ও সংসার চালাতে পারছে না। টানাটানির মধ্যে সংসার চালানো অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। মানুষের আয় বাড়েনি, অনেক চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের বেতন কমে গেছে। পক্ষান্তরে খরচের পাল্লা দিন দিন বাড়ছে। বিষয়টি করোনা মহামারির পর থেকে বারবার বলার চেষ্টা করা হলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি।
এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে অবকাঠামো ও জীবন যাপনের অনেক মানদণ্ডে সত্যিকারের উন্নয়ন হলেও জীবন জীবিকা নির্বাহে মানুষ সীমাহীন অসুবিধায় আছে। বিশেষ করে সংসারের হিসাব টানতে গিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গরিব মানুষকে চালসহ খাদ্যপণ্য কিনতেই আয়ের বেশিরভাগ অর্থ খরচ করতে হয়। এর মধ্যে চাল কিনতেই আয়ের চার ভাগের এক ভাগ খরচ হয়। মাছ-মাংস কেনাসহ অন্যান্য খরচ সামলে নিতে হয় নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যে।
আরও পড়ুন >>> ঋণ করে যেন ঘি না খাই
কয়েকদিন পরপর একেকটি পণ্য নিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়, আর দাম বাড়িয়ে সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট গ্রুপের কারসাজির কথা বারবার বলা হলেও শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। আর সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধে বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা কাটাতে সংস্কারের কথা বলা হলেও কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। যার ফল লুটে নিচ্ছে কিছু অসাধু চক্র।
বাজারে অতি মুনাফা ও মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে কথা হচ্ছিল সেগুনবাগিচায় এক শ্রমজীবীর সাথে তার বাসায়। দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ, বাসাভাড়া, দৈনিক বাজার খরচ-সব মিলিয়ে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করা তার পক্ষে বর্তমানে অসম্ভব হয়ে উঠছে। চালের দাম বাড়তি, আরও আছে তেল, ডালসহ আনুষাঙ্গিক বাজার খরচ।
বাসাভাড়া, ছেলেদের স্কুলের ব্যয় ও অন্যান্য ব্যয় অঢেল। সবমিলিয়ে মাসিক ব্যয় ২২ হাজার ৪৮০ টাকা। অথচ তার দিনে আয় হয় মাত্র ৬০০-৭০০ টাকা। অর্থাৎ ৭০০ টাকা করে হলে মাসে মোট ২১ হাজার টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে তার সাংসারিক খরচ বেড়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
একই বস্তির রোজিনারও একই অবস্থা। মাছের দাম অনেক বাড়তি, খুব কমই সবজিই আছে, যেগুলোর দাম এখন কেজিপ্রতি ৫০ টাকার নিচে। তাই তার মতো গরিবদের সংসার আর চলে না। টিসিবির কার্ডও তারা পাচ্ছে না। অনেক সময় টিসিবির পাঁচ কেজি চাল দেড়শ টাকার বদলে দুইশ টাকায়ও কিনতে হয়। দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সাংসারিক ব্যয় দেড় হাজার থেকে ২ হাজার টাকা বেড়েছে।
বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত। মাছের দাম বেড়েছে ৩০-৫০ টাকা পর্যন্ত। একটা সবজিও পাওয়া যায় না ৪০ টাকার নিচে। ছোট্ট একটা বাঁধাকপির দাম ৪০ টাকা! এটা ভাবা যায়। আলু তো সব সময় ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যেই থাকত। সেই আলু এখন ৪৫ টাকা!
বাজার ব্যবসায়ীরা বলেছেন, প্রতি বছর গ্রীষ্মের এই সময়ে সবজির দাম কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু এবার দেশে টানা বৃষ্টির কারণে সবজির দাম অন্যবারের তুলনায় বেশি। বাজারে ক্রেতাদের সাথে আলোচনায় জানা যায়, এখন বাজারে এলেই সবাই চোখে অন্ধকার দেখেন। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা লাগে না।
বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে প্রয়োজনে ডিম আমদানির ঘোষণায় দাম কিছুটা কমলেও এখনো স্বস্তি ফেরেনি। মাছ-মাংসের দাম বেশি হওয়ায় আগে থেকেই তা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এখন পুষ্টির বড় উৎস ডিমও তাদের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম। প্রাণিজ আমিষ বলতে ডিমই ছিল তাদের ভরসা। এখন ডিমের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধ্যের মধ্যে কোনটা?
বাজারে এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৫০ টাকার নিচে নেই। নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রায় সর্বশেষ সংযোজন ডিম। হোটেলে বছর দুই আগে ভাতের সঙ্গে ডিম আর ডাল খেলে লাগত ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এখন এক প্লেট ভাত আর ডিম খেলেই লাগে ৫০ টাকা। সঙ্গে অন্য কিছু নিলে লাগে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। মাছ আর মাংসের কথা ভাবাই যায় না। বাজারে পাল্লা দিয়ে একের পর এক বাড়ছে সবগুলো পণ্যের দাম। লাগামছাড়া দামের কারণে প্রান্তিক আয়ের মানুষ মাছ-মাংস খাওয়া আগেই কমিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, ডিমের দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ পোলট্রি ফিডসহ অন্য সব খরচ বেড়ে যাওয়া। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ফিডসহ অন্যসব খরচ বেড়ে গেছে। এতে ডিমের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
২০২০ সালে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ১৭ দশমিক ৩০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকার ওপরে। অথচ পোলট্রি খাদ্যে ভুট্টার ব্যবহার ৫৭-৫৮ শতাংশ। এছাড়া পোলট্রি খাদ্যে সয়াবিন খইলের ব্যবহার শতকরা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
২০২০ সালে প্রতি কেজি সয়াবিন খইলের দাম ছিল ৩৫-৩৬ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি সয়াবিন খইলের দাম ৮৪ টাকারও বেশি। এছাড়া জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, ডিজেল, বিদ্যুৎ, পরিবহনসহ সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এসব কারণে ডিমের দাম বেড়েছে।
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশে পণ্যটির বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শুল্কযুক্ত দামের পেঁয়াজ এখনো আমদানি না হলেও দেশের বাজারে একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি অন্তত ২০ টাকা বেড়ে গেছে। বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাবে হঠাৎ এমন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন সরবরাহ কম থাকায় পণ্যটির দাম বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এতদিন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে কোনো শুল্ক দিতে হতো না বাংলাদেশকে। হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় দেশটি। দেশটির বাজারে পেঁয়াজের দামের নাগাল টানতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানানো হয়। এইদিকে ভারত থেকে এখনো বাড়তি দামে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করেননি ব্যবসায়ীরা। তারপরও কেবল শুল্ক আরোপের খবর শুনেই দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি বিপদে পড়েছেন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষও। তারা যে আয় করছেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। ডিমের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পোলট্রি খাবার উৎপাদনে নীতি সহায়তা দেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সংসার আর চলে না
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিগুলো প্রণোদনাসহ নীতি সহায়তা দেওয়া হলে, উৎপাদনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর অবদান রাখতে পারে। একই সাথে পেঁয়াজের মজুদ বৃদ্ধি, বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা, পেঁয়াজের আড়তদার ও কমিশন এজেন্টদের বিক্রয় রশিদবিহীন ক্রয়-বিক্রয় বন্ধসহ এদের কর্মকাণ্ডকে তদারকির আওতায় আনতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো ও দেশব্যাপী বাজার ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সাথে পুরো বছরজুড়ে সমন্বিত বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে। যেসব নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট হতে পারে তার জন্য বাজার পর্যবেক্ষণ করে আগেই পূর্বাভাস দিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)