এমটিএফইর মতো প্রতিষ্ঠান যেভাবে ফাঁদে ফেলে
প্রতিষ্ঠানটির নাম মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ, সংক্ষেপে এমটিএফই। কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ বা এই রকম অন্য কোনো একটা দেশে নিবন্ধিত কোম্পানি, ওদের শারীরিক উপস্থিতি রয়েছে উত্তর আমেরিকাসহ আরও কয়েকটা অঞ্চলে আর ভার্চুয়াল উপস্থিতি আছে পৃথিবীব্যাপী। ওদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজ দেখলে বোঝা যায়, ওদের ব্যবসা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ও পণ্য কেনাবেচা ইত্যাদি।
গণমাধ্যমে দেখলাম, বিট কয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসাও করতো এই কোম্পানি। বিটকয়েন ব্যবসায় বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ লোকসান দিয়েছে। গণমাধ্যম বলছে, তারা বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।
বিজ্ঞাপন
এই টাকাটা বৈদেশিক মুদ্রায় দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে। দেশের অসংখ্য মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। ওদের একটা অ্যাপ আছে, সেই অ্যাপ ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষ অধিক লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছে, প্রথম দিকে কিছু লাভ হয়তো হয়েছে, কেউ কেউ কিছু টাকা পেয়েছেও, সেইসব দেখে বাকিদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে, আরও বেশি বেশি টাকা পাঠিয়েছে বিনিয়োগ হিসাবে, কিন্তু শেষে সকলেরই টাকা গেছে।
আরও পড়ুন >>> ই-কমার্স : লোভ একটি রোগের নাম
আমাদের দেশে এর আগে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে টাকা হারিয়েছে অনেক মানুষ। কম দামে অনলাইনে জিনিসপত্র কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেকে টাকা হারিয়েছে। মৌলবি-মৌলানাদের সহি ইসলামি কায়দায় বিনিয়োগ করতে গিয়েও নিঃস্ব হয়েছে অনেকে। সেইধরনের কোম্পানিও বিনিয়োগের নামে যারা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা যায়। তারা দেশি লোকজন, ধরাও পড়েছে অনেকে।
এমটিএফই কোম্পানিটি দেশি নয়। যতদূর জেনেছি এই কোম্পানি বাংলাদেশে নিবন্ধিত নয় এবং তাদের কোনো সাবসিডিয়ারিও বাংলাদেশে নিবন্ধিত হয়নি। ফলে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর যে রকম লাইসেন্স নেওয়ার কথা আছে ২০১৩ সালের প্রণীত আইনে এই কোম্পানি সেই আইনের অধীনে বা বাংলাদেশের অন্য কোনো আইনে কোনো প্রকার লাইসেন্স নিয়েছে বলেও প্রতীয়মান হয় না।
ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করা এমনিতেই পৃথিবীর যেকোনো দেশেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ কিছু আছে, যাদের মাধ্যমে আপনি ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে পারেন। সেইগুলোর কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নেই, যেকোনো দেশ থেকে আপনি বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনি বিটকয়েন বা অন্য কোনো ক্রিপ্টকারেন্সি কিনলে আপনার টাকার বিটকয়েনের অঙ্কে ব্লকচেইনে রেকর্ড করা থাকবে।
আমাদের দেশে এর আগে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে টাকা হারিয়েছে অনেক মানুষ। কম দামে অনলাইনে জিনিসপত্র কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেকে টাকা হারিয়েছে।
কোনো কাগজের টাকা বা কাগজের চেকবই বা পাসবই এই রকম কিছু আপনার থাকবে না। কম্পিউটার খুলে আপনি অনলাইনে আপনার ব্লকচেইন একাউন্টে যাবেন, সেইখান থেকে ইচ্ছেমতো লেনদেন করবেন। বিটকয়েনের দাম বাড়লে আপনার লাভ হবে, দাম কমলে লোকসান। মনে করেন, আপনি যে দামে বিটকয়েন কিনেছেন, তার চেয়ে দাম বেড়ে গেলে আপনার কয়েন আপনি আগ্রহী কারও কাছে বিক্রি করে দিতে পারবেন।
বিট কয়েনের এইসব লেনদেন হয় কিছু এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। যে এক্সচেঞ্জে আপনি বিট কয়েন কিনেছেন তাদের কাছ থেকে আপনি ডলার বা পাউন্ড কিনেছেন, বিক্রির পর ওরা বিক্রির টাকাটা আপনাকে আবার ডলার বা পাউন্ড হিসাবে ফেরত দেবে। এক্সচেঞ্জগুলো বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে কিছু ফি নেবে এটা হচ্ছে পদ্ধতি। কিন্তু যে ওয়েবসাইটকে আপনি প্রকৃত একটি বিট কয়েক এক্সচেঞ্জ মনে করেছেন, ওরা হতে পারে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান। বিটকয়েন কেনাবেচা কিছুই করে না, চমৎকার একটা ওয়েবসাইট খুলে আপনার কাছ থেকে টাকা নেবে।
আরও পড়ুন >>> ডেসটিনি, রফিকুল আমিন এবং জুম মিটিং ইতিবৃত্ত
প্রথমদিকে হয়তো ওদের পুরোনো খদ্দেরদের টাকা থেকে এমনিই আপনাকে কিছু টাকা দেবে মুনাফার নামে। পরে একটা পর্যায়ে গিয়ে সকলের টাকা নিয়ে ডুব মারবে। কে যে প্রকৃত এক্সচেঞ্জ আর কে যে নয় সেটা নির্ধারণ করাটাও কঠিন—কেননা বিট কয়েন বা অন্য কোনো ক্রিপ্টকারেন্সি এগুলোর তো কোনো সরকারি নিবন্ধন বা এই রকম কিছু লাগে না। ওদের ধরা কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের এমটিএফই পরিস্থিতি একটু ভিন্ন।
বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে টাকা পাঠানো খুব সহজ না। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিজেরা বৈদেশিক মুদ্রায় টাকা দেয়নি, ওরা টাকা দিয়েছে দেশি মুদ্রায়—বিকাশ, নগদ, রকেট বা এই রকম অন্য কোনো মাধ্যমে। এই টাকাগুলো দেশের মধ্যেই কারও না কারও কাছে জমা হয়েছে এবং পরবর্তীতে টাকাগুলো বিদেশে পাচার হয়েছে।
তার মানে কোনো স্থানীয় কোম্পানি থাক বা না থাক, বাংলাদেশে এমটিএফইর হয়ে কাজ করেছে এই রকম কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই রয়েছে। সেইসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা একটু কঠিন হতে পারে, কষ্টসাধ্য কাজ হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব কোনো কাজ বলে মনে হয় না। বিকাশ, নগদ, রকেট বা এইরকম সেবাগুলো বাংলাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের আইনে নিয়ন্ত্রিত। ওদের কাছ থেকে সরকার চাইলেই তথ্য পেতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে যারা এমটিএফইকে টাকা দিয়েছে, অনুমান করি এরাও বিটকয়েন বা অন্য কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের জন্য টাকা দিয়েছে। গণমাধ্যমে দেখলাম ওরা নাকি রীতিমতো সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে লোকজনদের উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে টাকা পাঠানো খুব সহজ না। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিজেরা বৈদেশিক মুদ্রায় টাকা দেয়নি, ওরা টাকা দিয়েছে দেশি মুদ্রায়—বিকাশ, নগদ, রকেট বা এই রকম অন্য কোনো মাধ্যমে। এই টাকাগুলো দেশের মধ্যেই কারও না কারও কাছে জমা হয়েছে...
দেশি-বিদেশি মানুষজন এসে বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে বুঝিয়েছে, আর আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন এলাকায় নাকি কিছুসংখ্যক লোক ছিল যারা এমটিএফইর প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তথ্য পাওয়া যাবে। ওদের লেনদেনের রেকর্ড বের করলে টাকার পদচিহ্ন খুঁজে বের করা যায়, টাকার গন্তব্যও বের করা যাবে। আগেই বলেছি, কাজটা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়।
এই ধরনের প্রতারণামূলক কাজ আগে থেকে প্রতিরোধ করা কঠিন। আমি সরকার বা অর্থ ব্যবসা যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য খুব বেশি দোষ দিতে চাই না। কিন্তু এইরকম একটা গণপ্রতারণা ঘটে যাওয়ার পর এগুলো খুঁজে বের করা দরকার এবং খুঁজে বের করার পর ওদের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
আরও পড়ুন : ই-কমার্স : নিরাপদ বিনিয়োগ ও অর্থ ফেরত প্রসঙ্গ
যারা বিনিয়োগ করে ঠকেছে, ওরা নিশ্চয়ই বোকামি করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ লোভে পড়ে বোকার মতো এইরকম প্রতারণার ফাঁকে ধরা দেবে তা তো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওদের আপনি বোকা বলে বকা দিতে পারেন, কিন্তু ওরা তো ভিকটিম, কী আর করা! কিন্তু যারা এইসব সহজ সরল লোকদের লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেছে ওদের ধরা দরকার এবং ওদের শাস্তি হওয়া খুবই জরুরি। না হয় এরাই আরও অনেক নতুন স্কিম নিয়ে হাজির হবে, নতুন করে আবার কিছু লোককে ঠকাবে।
১১ হাজার কোটি টাকা নেহায়েত কম টাকা নয়। এই টাকায় বিশাল বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করা যায়—বড়সড় কোনো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। এতগুলো টাকা দেশ থেকে ঠকিয়ে নিয়ে গেল, তাও আবার এই দুর্মূল্যের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রায়! এদের পাকড়াও করা তো জরুরি, ওদের পাকড়াও করে টাকাটা উদ্ধার করা জরুরি। এর পেছনে আদা জল খেয়ে লাগা তো সরকারের জন্য অবশ্য করণীয় একটা দায়িত্ব।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট