ছবি : সংগৃহীত

বিএনপি কিছু রাখঢাক করে না। তারা স্লোগান স্পষ্ট করে দিয়েছে—টেক ব্যাক বাংলাদেশ। কোথায় নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে? তারা ফের ২১ আগস্ট ঘটাতে চায়। ১৭ আগস্ট ঘটাতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা ধারণা করে, তাদের নির্মূল করতে চায়।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়ে এমন অবস্থায় নিয়ে যতে চায়, যেখানে আমরা ঢের পিছিয়ে থাকব পাকিস্তানের চেয়ে—যেমন ছিলাম ১৯৭১ সালে। তারা ছিল বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ শক্তিশালী। কিন্তু এখন বিভিন্ন সূচকে আমরা তাদের অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছি। যারা ‘টেক ব্যাক’ স্লোগান এনেছেন, তাদের মনের কথা ও অন্তরের জ্বালা স্পষ্ট—বাংলাদেশ কেন এত ভালো থাকবে!   

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ‘মহাপ্রলয়’ ঘটানোর জন্য ঘোট পাকিয়েছিল কারা? বিবিসির সাংবাদিক আকবর হোসেন ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর জানিয়েছেন, আদালত 'State-backed crime'-এর ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার জন্য যাদের চিহ্নিত করেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন—হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ২১ আগস্টের ঘটনার সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি এবং পরে এই বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, সাবেক সেনা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই তাজুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল খালেদা জিয়ার মন্ত্রী ও ১৯৭১ সালে কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে নৌবাহিনীর সাবেক অফিসার লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, গ্রেনেড হামলার সময় পুলিশ বাহিনীর প্রধান শহুদুল হক, গ্রেনেড হামলার সময় ঢাকার পুলিশ প্রধান আশরাফুল হুদাসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি।

আরও পড়ুন >>> একুশে আগস্ট : রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন

কেমন কোয়ালিশন গড়ে তুলেছিলেন তারেক রহমান, বুঝতে সমস্যা হয় না। এদের কেউ কেউ পরিকল্পনায় ছিলেন, কেউ কেউ দায়িত্ব নেন এক্সিকিউশনের। ঘাতকদের নিরাপদ রাখার ভার বর্তায় একটি অংশের ওপর।

গ্রেনেড হামলা হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য সমাবেশে। এই ঘটনা নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে থাকা জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান পরে লিখেছিলেন, সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন এবং কমান্ডে ছিলেন এমন ব্যক্তিরা যুক্ত না থাকলে এই ধরনের ‘বড় পরিসরের সামরিক অভিযান’ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

শেখ হাসিনা সেই সময় জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২১ আগস্ট একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণে তার শ্রবণশক্তি কমে যায়। তিনি হামলার কয়েকদিন পর খ্যাতিমান ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু লোক অবশ্যই জড়িত। মামলার বিবরণ ও রায়ের পর্যবেক্ষণে এর প্রমাণ মেলে।

ঘাতকদের কোয়ালিশনের মূল তিনটি রাজনৈতিক শক্তি—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হরকাতুল জেহাদ। ১৮ বছর পর বাংলাদেশের যে রাজনীতির সমীকরণ, তা তো ২১ আগস্টকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কোয়ালিশন আওয়ামী লীগকে সুসংহত করায় শেখ হাসিনার সাফল্যে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, সন্দেহ নেই।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনায় সচেষ্ট হন। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দম্ভভরে বলেছিল—‘আমরা মুজিবকে হত্যা করেছি। সাহস থাকলে কেউ বিচার করুক।’ ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর থাইল্যান্ডের ‘ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড’ লিখেছিল, ব্যাংকক পৌঁছে ফারুক রহমান জানান—এখানে পৌঁছার পরপরই তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান দূতাবাসে তাদের উপস্থিতির খবর জানিয়ে দিয়েছেন। ওই দুটি দেশে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।

আরও পড়ুন >>> ২১ আগস্ট : গ্রেনেড হামলার কলঙ্ক কী করে মুছবে বিএনপি 

৭ নভেম্বর ‘ব্যাংকক পোস্ট’ লিখেছে, জনৈক মার্কিন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ফারুক আজ (৬ নভেম্বর) মার্কিন কনস্যুলেটে আসেন এবং তারও আরও ১৬ জন অফিসারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের খুঁটির জোর খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না!

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাকে প্রাণে মেরে ফেলার অপচেষ্টা হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রায় সবাইকে একযোগে হত্যার জন্য বৃষ্টির মতো গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর প্রতিবাদে হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ।

জাতীয় সংসদে নিন্দা প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু প্রথম আলো পত্রিকা ২৮ আগস্ট একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছে—‘হরতালে অফিস না করলে বেতন কাটা।’ আর ১৪ সেপ্টেম্বর (২০০৪) আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘বিরোধীদলীয় নেতার প্রাণনাশের চেষ্টা নিয়ে সংসদে আলোচনা নেই।’

সংসদে আলোচনা না হলেও বিএনপির দুষ্টবুদ্ধি চলতেই থাকে। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালী জেলার সেনবাগ থেকে মো. জালাল নামে এক লোককে ধরে ঢাকায় নিয়ে এসে বলা হয়—এই লোক হচ্ছে জজ মিয়া। আওয়ামী লীগ সমাবেশে সে-ই ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করেছে। আর তাকে এই ‘দায়িত্ব দিয়েছিল’ আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ।

প্রকৃত ঘটনা জানতে বছর দুয়েক সময় লাগে দেশবাসীর। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শাসন ক্ষমতা নেয়। তারা ২১ আগস্টের নৃশংস ঘটনার প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানায়, জজ মিয়ার আসল নাম মো. জালাল। পেশায় সে দিনমজুর। তাকে পিটিয়ে এবং প্রলোভন দেখিয়ে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানো হয়েছিল।

এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমান কয়েক মাস জেল খাটার পর আর রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে ব্রিটেন পাড়ি জমান। আর লুৎফুজ্জামান বাবরের স্থান হয় কারাগারে।

খালেদা জিয়ার সরকার সংসদে আলোচনা করতে না দিলেও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সত্য উৎঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত  কমিটি গঠন করেছিল। এক সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয় আপিল বিভাগের বিচারপতি জয়নুল আবেদিনকে।

আরও পড়ুন >>> ফিরে এলেন দুঃসাহসী নাবিক 

প্রথম আলো ২০০৪ সালের ১৯ অক্টোবর জানায়, তদন্ত কমিশন অনেক অনুসন্ধানের পর সন্ধান পেয়েছে—‘বিদেশি চরেরা এই গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করেছে। ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে মোটর সাইকেলে পালিয়ে যাওয়া দুই ব্যক্তিকে পাকড়াও করতে পারলেই সব রহস্য ভেদ করা সম্ভব হবে। ওই দুই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে ধরে ফেলার ওপরেই এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।’

বিএনপি মিথ্যাচারে কতটা যেতে পারে, তার প্রমাণ মেলে পরের বছর ১৭ আগস্ট। এই দিন দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩টিতে প্রায় একই সময়ে অন্তত পাঁচশ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। বিএনপির কোয়ালিশন শরিক জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বলেন—এসব আওয়ামী লীগের কাজ। আর বিএনপি নেতারা বলেন—আওয়ামী লীগ ছাড়া সাড়া দেশে এক সঙ্গে বোমাবাজি করার মতো লোক আর কোনো দলে নেই। [প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০০৫]

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেলায় জেলায় পুলিশের কাছে বার্তা গেল—আওয়ামী লীগ নেতাদের ১৭ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় ফাঁসাতে হবে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট ফেঁসে গেল সাতক্ষীরার এক পকেটমারের কারণে। ১৭ আগস্ট সে দেখেছিল—আদালত চত্বরের এক স্থানে এক ‘মওলানা সাহেব’ একটি পোটলা রেখে চলে যায়। একটু পরেই ওই পোটলায় বিস্ফোরণ ঘটে, যেখান থেকে বের হয় কয়েকটি লিফলেট—ইসলামী বিপ্লবের ডাক। ৬৩ জেলায়ও মেলে একই ধরনের লিফলেট।

কয়েকদিনের মধ্যেই জানা গেল, বোমাবাজির পেছনে রয়েছে জেএমবি নামে একটি ধর্মান্ধ চরমপন্থী গোষ্ঠী, যাদের উত্থান বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মদদে। তারা ১৭ আগস্টের ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে গাজীপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, নেত্রকোণাসহ কয়েকটি স্থানে আত্মঘাতী হামলা চালায়।

‘মানুষের তৈরি সংবিধানের শাসন চলবে না’—এই স্লোগান নিয়ে সক্রিয় দলের একাধিক নেতা ১৭ আগস্টের বোমা হামলার পর দম্ভভরে বলেছিল—‘হাল্কা ক্ষমতা’ দেখালাম। সামনে আরও বড় কিছু আসছে। এই গোষ্ঠীর নেতা শায়ক আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইকে বিএনপির শাসনামলেই গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ এই দুই ব্যক্তিসহ জেএমবির ছয় নেতার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের ‘কোয়ালিশন’ বিএনপি ২০১২ থেকে ২০১৫ সালেও সক্রিয় রেখেছিল। তখন রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি পেট্রলবোমার নির্বিচার ব্যবহার বাংলাদেশ দেখেছে। ২০২২-২০২৩ সালে ফের এই কোয়ালিশন সক্রিয় হয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যারা ঘটিয়েছিল তাদের পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় মদদ। এখন রাষ্ট্রীয় মদদ পাচ্ছে না বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখার চক্রান্তে লিপ্ত অপশক্তি। এই কারণেই তাদের স্লোগান ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যেন ফের রাষ্ট্রীয় মদদ মেলে।

অতএব, হুশিয়ার বাংলাদেশ!

অজয় দাশগুপ্ত ।। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা