ছবি : সংগৃহীত

প্রবাদের জ্ঞান অসাধারণভাবে চতুর কারণ তা বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে। যেমন ধরা যাক, এই প্রবাদটির কথা—একজন মানুষকে একটি মাছ দিন, এতে তার একদিনের আহার আসবে; তবে তাকে মাছ ধরা শিখালে সে বাকি জীবন খেতে পারবে।

পশ্চিমা দেশের উন্নয়নের ধারণা এই প্রবাদের আশেপাশে ঘুরলেও চীনের উন্নয়নের ধারণা একটু আলাদা। চীন উন্নয়নের প্রতি যে বিশ্বাস ধারণ করে তা রূপকথার মতো অস্পষ্ট।

২০২২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বেইজিংয়ের তিয়াওইয়ুথাই রাষ্ট্রীয় অতিথিভবনে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হওয়ার খবর জানা যায়। চীনা গণমাধ্যমগুলোর ভাষ্যে, দুই প্রেসিডেন্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে চীন-ইন্দোনেশিয়া সম্পর্ক এবং অভিন্ন স্বার্থজড়িত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে ব্যাপক ও গভীরভাবে মতবিনিময় করেন।

বৈঠকে তারা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যেও পৌঁছান। বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের পর প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো হলেন প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান যাকে চীনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মহামারির পরে প্রেসিডেন্ট জোকো-র প্রথম পূর্ব-এশিয়া সফরের প্রথম গন্তব্যও চীন।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেই বৈঠকে বলেছিলেন, ‘চীন ও ইন্দোনেশিয়ার জন্য উন্নয়নের পর্যায় প্রায় একই এবং যৌথ স্বার্থও পারস্পরিক সংযুক্ত। চীন ও ইন্দোনেশিয়ার অভিন্ন স্বার্থের কমিউনিটি গড়ে তোলা হচ্ছে দুই দেশের জনগণের অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সাধারণ প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন >>> কূটনীতির নতুন মাত্রা 

যৌথভাবে চীন-ইন্দোনেশিয়া অভিন্ন স্বার্থের কমিউনিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা নির্ধারণে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে চীন যৌথভাবে কাজ করে পারস্পরিক কৌশলগত আস্থা জোরদার করবে; একে অপরের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখবে; পরস্পরের উন্নয়ন-পথকে সমর্থন করবে; এবং একে অপরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের কাজকে সমর্থন করবে।’

সেইবারের ভ্রমণ থেকে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সবুজ উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে আগ্রহী বেইজিং। জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে ইন্দোনেশিয়াকে সহযোগিতা করবে চীন এবং এই সম্মেলন সফল করতে ইন্দোনেশিয়ার সাথে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে ইচ্ছুক চীন।

বৈঠকশেষে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। পরে, দুই নেতা রেশমপথ অর্থনৈতিক এলাকা ও ২১ শতাব্দীর সামুদ্রিক রেশমপথ প্রস্তাব, টিকা, সবুজ উন্নয়ন, সাইবার নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক দলিলপত্র সাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।

আমরা দেখেছি, বিআরআই এক কথায় এশিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত উদীয়মান বাজারগুলোয় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি করার কাজ করছে। চলতি খবর বলছে, ইন্দোনেশিয়া চীনা অর্থায়নে রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অংশ হিসেবে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়।

বেইজিংয়ের সঙ্গে বিশ্ববাজারের বড় অংশটিকে যুক্ত করতে উদীয়মান দেশগুলোয় অবকাঠামো নেটওয়ার্ক তৈরির প্রকল্প বিআরআই। এজন্য এখন পর্যন্ত এক হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে চীন। উদ্যোগে নিয়ে নানান সমালোচনা প্রথম থেকেই দেখা যায়। অনেকক্ষেত্রে তহবিল খালি হওয়া, চলমান প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়া এবং গ্রহীতা দেশগুলো ঋণের ভারে ডুবতে বসা, প্রকল্পের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্নসহ নানান সংকট দেখা যায়।

অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়ার হাই-স্পিড রেলওয়ে প্রকল্প আগামী সেপ্টেম্বরে চালু করার নতুন দিন ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটি জমি সংক্রান্ত বিরোধ, অতিরিক্ত খরচসহ নানান সমালোচনার মুখে পড়েছে। কয়েকবার সময় পেছানো হয়েছে এরই মধ্যে।

আরও পড়ুন >>> শ্রীলঙ্কার নিরুদ্দেশ যাত্রা 

যদিও কর্মকর্তাদের ভাষ্যে, ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চালু হবে। পিটি-কেসিআইসি ১৪২ কিলোমিটার রেলওয়ে নির্মাণের কাজ করছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ট্রেনলাইন পরীক্ষা নিয়ে তেমন কোনো সংকট দেখছে না বলে জানিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা দিবসের আয়োজনের অংশ হিসেবে উদ্বোধন করা হবে এই ট্রেন।

সরকারের আশার বাণী জনগণের কানে আসলেও প্রকল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালফিকার জানান, এই বিলম্বিত​​ হওয়ার কারণে আসলে জনগণের ভাবমূর্তি দুর্বল হচ্ছে। ১৭ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে এই প্রকল্প চালু হওয়ার কথা থাকলেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

নতুন রাজধানী নুসানতারাতে অনেক জমজমাট আয়োজন করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে এই প্রকল্প চালুর কথা থাকলেও এখনো কাজ চলছে। এরই মধ্যে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়তি খরচ হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ট্রেন ঘণ্টায় ৩৮৫ কিলোমিটার ছুটবে, কিন্তু চালু হবে কবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আসিয়ান অঞ্চলে প্রথম হাই-স্পিড ট্রেন হিসেবে অনেক দিন আলোচনায় আছে এই প্রকল্প। এই ট্রেনে বর্তমান রাজধানী জাকার্তা থেকে ওয়েস্ট জাভার বান্দুং পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ থাকবে। সব মিলিয়ে খরচ পড়ছে ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চীনের বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ঋণসহ নানান প্রশ্ন দেখা যায়। বাংলাদেশে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ জাপান, তারপরেই আছে চীন। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে চীনা ঋণের উপস্থিতি সরাসরি দেখা যাচ্ছে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৪১০ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ রয়েছে। আর চীনের বিনিয়োগ ১৩৪ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। দেশের গ্যাস ও জ্বালানি তেলে বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮৭ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন >>> আমেরিকার প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য কতটা উপকারী? 

দেশীয় বিশ্লেষকেরা চীনা ঋণের শঙ্কা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলেন। সরকার সেই ফাঁদে পড়বে না বলেও অনেকবার আশ্বস্ত করেছে। চীনা ঋণের ফাঁদ নিয়ে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা আমাদের কানের আশেপাশেই ঘুরছে।

চীন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নানান উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নিজের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে মহাসড়ক, রেলপথ, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট, খনিজ আহরণ প্রকল্প ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামোয় বড় আকারে ঋণ দিচ্ছে।

অনেক দেশ চীনা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে। শ্রীলঙ্কার বন্দর হারানোর সংবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে যারা খোঁজ রাখেন, তাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা বন্দরকে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়।

পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর ব্যবহার নিয়েই আলোচনা নেই। গণমাধ্যমের নানান সংবাদ বলছে, লাওস, জিবুতি, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, কিরগিস্তান এবং তাজিকিস্তানের মতো দেশগুলো নানা প্রকল্পের কারণে চীনা ঋণের ফাঁদে আটকে গেছে। এসব ফাঁদ কিংবা বিলম্বের সংবাদ দেখে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা প্রয়োজন। রূপকথা গালগল্পে সুন্দর, বাস্তবে আসলে ফাঁদ হলে দেশের জন্য বিপদ।

নাফিসা নাজীন লুৎফা ।। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্