দৃষ্টি এখন লাতিন আমেরিকার দিকে
সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনামের বন্যা সক্ষমতা বিকাশে ২ লাখ ডলারের কার্যক্রম চালু করেছে। সুরিনাম সরকারের অনুরোধে ভারত-জাতিসংঘ উন্নয়ন পার্টনারশিপ ফান্ডের অংশ হিসেবে এই অর্থ প্রদান করা হয়েছে। বন্যার পূর্বাভাস ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নে এই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
সুরিনামে ২০২৩ সালে বেশ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া আধুনিক আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র নেই সুরিনামে। সেই লক্ষ্যে ভারত এই সহায়তা প্রদান করছে। ২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউইয়র্কে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশসমূহের নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করেন। লাতিন আমেরিকা নিয়ে অনেক বছর ধরেই ভারতের আগ্রহ চোখে পড়ে না। ভারতের বিদেশ নীতির শেষ সীমান্ত বলে মনে করা হয় লাতিন আমেরিকাকে।
বিজ্ঞাপন
ভারত ২০২১-২২ সালে প্রথমবার ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বার্ষিক রপ্তানি অর্জন করে। লাতিন আমেরিকার সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কম। এই অঞ্চলে ভারতের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রচুর বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
নয়াদিল্লি ২০১৬ সালের পরে লাতিন আমেরিকা নির্ভর নানান কাজ শুরু করে। লাতিন আমেরিকাকে নিয়ে ভারতের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি আছে। তা কার্যকর করার সুযোগ বাড়ছে। লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের ফুটবলের খাতিরে ভারতের জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিবিদদের লাতিন আমেরিকায় পা রাখতে দেখা যায় না।
আরও পড়ুন >>> আমেরিকার প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য কতটা উপকারী?
সম্প্রতি আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের গোলকিপার মার্টিনেজ কলকাতা ঘুরে গেলেন। দিল্লির সাউথ ব্লকে লাতিন আমেরিকার গুরুত্ব বাড়ানো প্রয়োজন বলে ভূ-বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ব্রাজিলে ভারতের রপ্তানি ৬.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মেক্সিকোতে ৪.৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
গাড়ি, মোটরসাইকেল, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, জৈব ও অজৈব রাসায়নিক এবং টেক্সটাইলগুলোর জন্য লাতিন আমেরিকা অন্যতম প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে খনিজ ও উদ্ভিজ্জ তেল আমদানি করে ভারত।
লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক ব্যবসার জন্য গোল্ডিলক্স জোন হিসেবে স্বীকৃত। জনসংখ্যার দিক থেকে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ বিশ্বব্যাপী বিকশিত বাজারগুলোর একটি। লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করে।
পরাশক্তিদের আগ্রহ
বিবিসির হিসেবে, বিশ্বের মোট লিথিয়ামের অর্ধেকেরও বেশি পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকার তিনটি দেশে—আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলি। এই তিনটি দেশের লিথিয়ামের বাজারের ওপর অনেকদিন ধরেই শুধু ব্যবসায়ীদেরই নয়, অনেক দেশের সরকারেরও তীক্ষ্ণ নজর আছে। ফলে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিত করতে তৎপর।
জ্বালানির বাজার রূপান্তরিত হচ্ছে এবং সেই সাথে প্রধান শক্তিধর দেশগুলো বিকল্প জ্বালানির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। আর সেই প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে লাতিন আমেরিকা, বলেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের লাতিন আমেরিকা বিভাগের পরিচালক বেনজামিন জেদান।
চীনা কোম্পানিগুলো হোয়াইট গোল্ড (শ্বেত সোনা) নামে খ্যাত লিথিয়ামের মজুদ নিশ্চিত করতে অনেক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পরাশক্তিরা ছুটছে লাতিন আমেরিকায়, বাংলাদেশ সেই দৌড়ে কতটা এগিয়ে তা নিয়েই অনেক বছর ধরে চলছে আলোচনা।
বাংলাদেশ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আছে। আমরা দেখেছি, এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে লাতিন আমেরিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
আরও পড়ুন >>> কূটনীতির নতুন মাত্রা
লাতিন আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এলএবিসিসিআই) ও বিডার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চুক্তি করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) ইভেন্ট ইন লাতিন আমেরিকা’ যৌথভাবে বিডা, ডিবিসিসিআই এবং এলএবিসিসিআই নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল এই আয়োজন করছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, লাতিন আমেরিকায় বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, টেক্সটাইল, সয়াবিন, সূর্যমুখী, লৌহ আকরিক, পেট্রোলিয়াম তেল, সার, তৈরি পোশাক, পাট, চামড়া ও ওষুধ রপ্তানি খাতগুলোর ওপর বিটুবি নেটওয়ার্কিং ও সেমিনার আয়োজন করা হচ্ছে নিয়মিত।
বাংলাদেশের সুযোগ
বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর ও বিস্তৃত সম্পর্ক গড়তে চায় লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। রাজধানীর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) এক সেমিনারে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের নয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা অংশ নেন।
‘বাংলাদেশের সঙ্গে ল্যাতিন আমেরিকার সম্পর্ক: সম্ভাবনার নতুন দুয়ার’-শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিআইআইএসএস। সেমিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের নয়টি দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও মিশন প্রধানরা বক্তব্য রাখেন। এর মধ্যে ব্রাজিল ছাড়া অন্যরা অনাবাসী হিসেবে দিল্লিতে অবস্থান করেন।
সেমিনারে দিল্লি থেকে ডোমিনিকান রিপাবলিক, কলাম্বিয়া, মেক্সিকো, ইকুয়েডর, পেরু, ভেনিজুয়েলা, গায়ানা ও ত্রিনিদাদ টোবেগো মিশন প্রধানরা যোগ দেন। সেই সম্মেলনে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের নয়টি দেশের মিশন প্রধানরা বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর ও বিস্তৃত করার জন্য ঘোষণা দেন।
ওষুধ, চামড়া, সিরামিক, প্লাস্টিক ও মেলামাইন সামগ্রীর বিশাল বাজারের সুবিধা নিতে চায় বাংলাদেশ। তাছাড়া আইটি পণ্য ও সেবা, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য ছাড়া কৃষিকাজে বাংলাদেশ সেইখানে অবদান রাখতে পারবে বলে আলোচনা করা হয়।
ফুটবল দিয়ে শুরু, অত:পর
এরই মধ্যে ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু হয়েছে। আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রাজধানীর বনানীতে আর্জেন্টিনা দূতাবাসের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর পর ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> শ্রীলঙ্কার নিরুদ্দেশ যাত্রা
এর আগে আর্জেন্টিনার সামরিক সরকার ১৯৭৮ সালে ঢাকার দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক কার্যক্রম ও ভিসা সংক্রান্ত কার্যক্রম ভারতের দূতাবাস থেকে পরিচালিত হতে থাকে। আর্জেন্টিনার নতুন দূতাবাসের উদ্বোধন এবং বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বন্ধন আরও গভীর করতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সকালে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো ঢাকায় ঘুরে যান।
ব্যবসার দিগন্ত বাড়ছে
বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ব্রাজিলের বর্তমান ওষুধপণ্যের বাজারের আয়তন প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের মধ্যে ব্রাজিল পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ওষুধপণ্যের বাজার হবে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের সামনেও সেই সুযোগ আছে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আর্জেন্টিনার চেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল অনেক বছর ধরে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনায় রপ্তানি হয়েছে ৯৫ লাখ ডলারের পণ্য আর ব্রাজিলে হয়েছে প্রায় ১১ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলে যেমন পণ্য রপ্তানি হয়, তেমনি সেই দেশ থেকে আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশটিতে ২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ২৪০ কোটি টাকা। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কার্যকর ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার পরিচিত বাজারের গণ্ডি পেরিয়ে লাতিন আমেরিকায় চোখ রাখার এখনই সময় বলা যায়।
জাহিদ হোসাইন খান ।। গবেষক