ডেঙ্গু যেভাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে
পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই ডেঙ্গু ও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর খবর। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সব ইতিহাস ভেঙে ২০২৩ সাল ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড হলো। এমন রেকর্ড আমরা চাই না।
আমরা চাই ডেঙ্গুতে একজন মানুষেরও মৃত্যু না হোক। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারীদের তুলনায় পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত। মোট আক্রান্তের ৬৩.৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬.২ শতাংশ নারী।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে মৃত্যুর হারে নারীরাই বেশি। মোট মৃত্যুর ৫৫.৪৭ শতাংশ নারী এবং ৪৪.৫২ শতাংশ পুরুষ। ১৬ থেকে ৩৫ বছরের নারী পুরুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। যে বয়সী মানুষজন সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকেন সেই বয়সী নারী পুরুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন যা একটি দেশের জন্য বিরাট আর্থিক ক্ষতির কারণ।
আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়?
ডেঙ্গু এক সময় শুধুমাত্র ঢাকার রোগ ছিল কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে। ধীরে ধীরে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্ট করার দীর্ঘ লাইন বলে দিচ্ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। ইতিমধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার NS1 কিটের সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে কিটের স্বল্পতা থাকার কারণে কিছু কিছু কোম্পানি দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকার হাসপাতালগুলো এখন ডেঙ্গু রোগীতে পরিপূর্ণ। মুগদা মেডিকেল কলেজ বছরের শুরু থেকে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য। মুগদা মেডিকেল কলেজের পরিচালক সেইদিন হতাশ হয়ে বলছিলেন, তিনি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন, কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। দু-একটি হাসপাতাল বাদে একই চিত্র ঢাকার প্রায় সব সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের।
ডেঙ্গু এক সময় শুধুমাত্র ঢাকার রোগ ছিল কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে। ধীরে ধীরে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ল্যাবে আমরা একটি ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি যার মাধ্যমে আর্লি ওয়ার্নিং দেওয়া যায়। কয়েক বছরে যতগুলো ফোরকাস্টিং আমরা করেছি তার প্রতিটি সঠিক হয়েছে। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এই কয়েকটি প্যারামিটারকে মাল্টিভেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করা হয়।
বর্তমান মডেলে আমরা যেটি দেখতে পাচ্ছি তাতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে না রাখতে পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আগামী দুটি মাস যেহেতু ডেঙ্গু ঝুঁকি বেশি তাই এডিস মশা নিধন ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রমগুলো আরও বেগবান করা প্রয়োজন।
এই মুহূর্তে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলে হবে না। হটস্পট ধরে ধরে উড়ন্ত মশা নিধন কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সব জায়গায় প্রজনন স্থল ধ্বংস (সোর্স রিডাকশন) করতে হবে। মশার লার্ভা ধ্বংসে নতুন প্রজন্মের বায়ো লার্ভিসাইড বিটিআই এর প্রয়োগ করতে হবে। এই কাজে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণ ও সামাজিক সংগঠনকেও সম্পৃক্ত হতে হবে।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব?
সামাজিক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে বেশকিছু কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তবে তাদের কার্যক্রম র্যালি, ব্যানার-লিফলেট এবং ফগিং এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ আছে। ব্যক্তি বা সামাজিক সংগঠনগুলোর যে কাজটি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে করতে হবে সেটি হলো এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা।
প্রত্যেকটি বাড়ি, মহল্লায়, অফিস, আদালতে এডিস মশার প্রজনন পাত্র যদি আমরা ধ্বংস করতে পারি তাহলে সবচেয়ে বেশি ফলাফল আসবে। ডেঙ্গু এখন কমিউনিটি রোগে পরিণত হয়েছে তাই কমিউনিটি যুক্ত হওয়া ছাড়া এখন ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
বর্তমান মডেলে আমরা যেটি দেখতে পাচ্ছি তাতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে না রাখতে পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
রোগীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে হাসপাতালে যেতে পারেন তেমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড খোলা বা প্রস্তুত রাখা যেতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্রা সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া যায় কি না সেই বিষয়টিও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
ডেঙ্গুর সফল ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট-এর জন্য সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতো বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদেরও পর্যাপ্ত ট্রেনিং দেওয়া জরুরি।
অভিযোগ আছে চাহিদা বেশি থাকার কারণে মানহীন NS1 কিট বাজারে ঢুকে যাচ্ছে তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে NS1 কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনসাধারণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার কারণে রোগী, রোগীর আত্মীয়-স্বজন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স এবং মশা নিয়ন্ত্রণের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ চাপের মধ্যে আছেন। রোগী, রোগীর আত্মীয়-স্বজন এবং রোগী ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধৈর্য হারা হচ্ছেন। এই সময়ে ধৈর্য ধারণ করে যার যার অবস্থান থেকে কাজগুলো সঠিকভাবে চালিয়ে যেতে পারলেই ডেঙ্গুকে মোকাবিলা করা সম্ভব।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com