ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের দোহাজারী। বানের জলে ভেসে গেলেন দাদা আর নাতি। ৮৩ বছর বয়সী দাদা আবু সৈয়দ ১০ বছরের নাতি আনাসকে নিয়ে পূর্ব দোহাজারী মোহাম্মদপাড়া থেকে পৌরসভার জামিজুরীতে তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যান তারা।

৯ আগস্ট উদ্ধার হয় আনাসের মরদেহ। আর ১০ আগস্ট দাদার। দুটি নবীন-প্রবীণ প্রাণ ভেসে গেল বানের জলে। রাষ্ট্রের কারও কোনো শোক নেই। কোনো দায় নেই। কোনো আক্ষেপ নেই। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই। এরা তো সাধারণ মানুষ তাই না? সাধারণের জন্য আবার এত আদিখ্যেতা কীসের?

সব চলছে স্বাভাবিক। যেমন চলে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক নেতারা ঘরে, মাঠে, মাইকের সামনে গলা ফাটাচ্ছেন। চেঁচিয়ে চলেছেন নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে। নেতার মুক্তি কামনায় সরব রাজনীতির মাঠ। আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা রোধের প্রাণপণ প্রতিজ্ঞায় সরব রাজনীতির মাঠ।

আরও পড়ুন >>> পাহাড়ি ঢলে ভাঙল বাঁধ : ফসল ডুবির দায় কার? 

সাধারণ মানুষের কথা ভাবার সময় কই তাদের। হ্যাঁ, পত্রিকার পাতা খুললে, টেলিভিশনের স্ক্রিনে চোখ রাখলে কিছু খবর এবং ছবি চোখে পড়বে বন্যার্ত মানুষের দুঃখ দুর্দশায় কতটা কাতর আমাদের দেশের হর্তাকর্তারা। বানভাসি মানুষের সহায়তার জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার তালিকাও জানতে পারবেন নানা মাধ্যম থেকে। কিন্তু প্রতি বছর বন্যা কেন হয়? কেন ঠেকানো যায় না বন্যার ভয়াবহতা? সেই প্রশ্ন রাখলে কোনো উত্তর পাবেন না। মাছের মতো নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে থাকবে শুধু।

আচ্ছা, বন্যা যে হতে পারে তার কোনো আগাম সংকেত আমরা পায় না কেন? বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র নামে সরকারি একটা সংস্থা তো আছে! তারা কী করেন? তারা কি আগাম সতর্কতা দেন? যদি দিয়ে থাকেন, তাহলে সেই প্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়?

দুটি নবীন-প্রবীণ প্রাণ ভেসে গেল বানের জলে। রাষ্ট্রের কারও কোনো শোক নেই। কোনো দায় নেই। কোনো আক্ষেপ নেই। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই। এরা তো সাধারণ মানুষ তাই না?

নেদারল্যান্ডের মতো একটা দেশ যার পুরোটাই জলে ভাসা। সাগরের পেটে থাকা ছোট্ট এই দ্বীপ দেশটা তো কখনো বানের জলে ভেসে যায় না! কেন যায় না? কারণ তারা টেকসই বাঁধ নির্মাণ করেছেন। থাক, অতো দূরে যাওয়ার দরকার নেই।

পাশের দেশ ভারতের দিকেই তাকাই। তারাও তো টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরা কেন পারি না? আমাদের এখানে এই রকম বাঁধ কই? বাঁধের নামে আমরা যেসব নির্মাণ করি সেইগুলো কি বন্যা ঠেকায়? নাকি নতুন দুর্ভোগ তৈরি করে?

আমাদের বেশিরভাগ বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে বানানো এবং ক্ষণস্থায়ী। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি করে। আবার কোনো কোনো বাঁধ এতটাই হালকা করে বানানো যে বানের জল একটু চাপ দিলেই ভেঙে তছনছ হয়ে যায়।

নদী শাসন বলতে আমরা বুঝি নদীতে বালুর বস্তা ফেলা। এটি হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। কত বস্তা বালু পানিতে ফেলা হলো, আর কত বস্তার হিসাব দেখানো হলো খাতা কলমে, তারা ব্যস্ত সেই কাজে। অথৈ নদীর জলে ফেলা বালির বস্তার সঠিক হিসাব বের করার সাধ্য কার আছে?

আরও পড়ুন >>> কেন বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে? 

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম কয়েকদিন ধরে তলিয়ে থাকলো জলের নিচে। নগর পিতা গাড়ি রেখে বাধ্য হয়ে অফিসে গেলেন রিকশায় চড়ে! এটি কি বন্যার জল? না। অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে গেল নগরী।

প্রতি বর্ষাতেই চট্টগ্রামে এমনটা হয়ে থাকে। কেন হয়? কেন বৃষ্টির জল সরতে পারে না? প্রশ্ন করতেই পারেন। সেই প্রশ্নও ভেসে যাবে বানের জলের সঙ্গে। অথবা আটকে থাকবে কাদামাখা বৃষ্টিজলের সঙ্গে। উত্তর পাবেন না কারও কাছ থেকে। এখানে জনগণের যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নিয়ম নেই সংশ্লিষ্ট কারওই।

রাজধানী ঢাকার অবস্থা কী? নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য তিলোত্তমা ঢাকাকে দুই সিটিতে ভাগ করা হলো। লাভের লাভ কী হয়েছে? এখনো একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাজপথগুলো একেকটা হয়ে ওঠে নদী। সেই নদীর পানিতে ভাসে নগরীর সব ক্লেদ। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। জবাবদিহিতা নেই। শুধু কথার ফুলঝুরি। আর লোক দেখানো, লোক হাসানো নানা কর্মকাণ্ড।

আবার ফিরি বন্যা প্রসঙ্গে। চট্টগ্রাম কক্সবাজারসহ বেশকিছু জেলায় বন্যা হচ্ছে এখন। এই তো কিছুদিন আগে বন্যায় প্লাবিত হলো দেশের উত্তরের বেশকটি জেলা। একই সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের কয়েকটি জেলাও পড়েছিল বন্যার কবলে। এজন্য দোষারোপ করা হয়েছিল উজানের দেশ ভারতকে। দোষারোপে আমরা এগিয়ে থাকলেও কাজে কিন্তু আগায়নি।

পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যা দেখা দেয় সিলেট অঞ্চলে। আর উত্তরবঙ্গ প্লাবিত হয় তিস্তার পানির কারণে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, তিস্তায় আবারও বাড়ছে পানি। চোখ রাঙাচ্ছে বন্যার শঙ্কা। এত বছর পেরিয়ে গেল, এত সরকার এলো গেল, এখনো তিস্তার পানি চুক্তি করা গেল না। কবে হবে? উত্তর মিলবে কোথায়?

নদী শাসন বলতে আমরা বুঝি নদীতে বালুর বস্তা ফেলা। এটি হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। কত বস্তা বালু পানিতে ফেলা হলো, আর কত বস্তার হিসাব দেখানো হলো খাতা কলমে, তারা ব্যস্ত সেই কাজে।

গেল দেড় দশকে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। সেই জায়গা থেকেই বলতে চাই—একটা সময় ছিল যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতিকেই দোষারোপ করা হতো। এখন কিন্তু সেই দিন আর নেই।

প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। মানুষ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আর নিরুপায় হয়ে বসে থাকে না। বরং দুর্যোগ মোকাবিলার আগাম নানা ব্যবস্থা এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। সুতরাং একটু সচেতন হলে, একটু সতর্কতা এবং সততার সঙ্গে উদ্যোগ নিলে বন্যা রোধ করা অসম্ভব কিছু না।

আরও পড়ুন >>> ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ : বঙ্গোপসাগরে নয়, ঝড় তুলছে কফির কাপে

শুধু সরকার নয়, নাগরিকেরও কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ নির্বিচার দখল আর দূষণে আমাদের নদীগুলো প্রায় মেরে ফেলেছি আমরা। কারা করছে এই নদী দখল, ভূমি দখল। সেই প্রভাবশালীরা কারা? কারা তাদের পেছন থেকে ইন্ধন দেয়? সাহস দেয়? শক্তি দেয়? সবই কিন্তু জানা।

আসুন সবাই মিলে তাদের প্রতিরোধ করি। সম্মিলিতের প্রতিবাদের কাছে ওইসব অন্ধকারের শক্তি পরাজিত হবেই। সব কথার শেষ কথা হলো—এই দেশটা আমাদের। প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা সবাই বড় বেশি ভালোবাসি। ভালোবাসার শক্তিই পারে একটি বাসযোগ্য দেশ গড়তে।

প্রাকৃতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাত আসবেই। তা নিয়েই জীবন। কিন্তু দুর্যোগগুলো যেন না হয় মানুষ সৃষ্ট। দুর্যোগগুলো যেন না হয় মানুষের লোভের ফলে। লোভ কিন্তু খুব খারাপ জিনিস।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি