ছবি : সংগৃহীত

অবশেষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারকদের ধন্যবাদ। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সচেতন মহলের প্রবল আপত্তির মুখে এই আইন প্রণীত হয়েছিল। এরপর প্রায় পাঁচ বছরের অধিকাংশ সময়েই এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, নিরপরাধ মানুষের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

মূলত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এর ব্যাপক অপপ্রয়োগের কারণেই। কারণ এই আইনের ধোঁয়াটে ধারাগুলো এমনভাবে সন্নিবেশন করা হয়েছিল যে এই আইন প্রয়োগ করলেও তা অপপ্রয়োগ হয়ে যেত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যিকারের অপরাধীরাও এই আইনের আওতায় বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু সেইগুলো উচ্চকিত হয়নি অপপ্রয়োগের ব্যাপকতায়।

সরকার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ নামে নতুন একটি আইন করার কথাও জানিয়েছে। আশাকরি এই আইনটি সত্যিকার অর্থে একটি ভালো আইন হবে, যে আইনে কার্যকরভাবে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবেন না এবং অপপ্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে।

আরও পড়ুন >>> সাংবাদিক যখন নির্যাতনের শিকার 

তবে এখানে আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। কারণ ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়েছিল। আবার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ আইনটিও হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে। বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদও আর বেশি নেই। এই অবস্থায় নতুন একটি আইন কতটা ভালোভাবে করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। যদিও এর মধ্যে সরকার নতুন আইনের প্রস্তুতিটা নিয়ে থাকে, সেটা ভালো। কিন্তু নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তুতি এখনো দৃশ্যমান নয়, সেইটাই সংশয়ের কারণ।

একটা বিষয় অবশ্য আশাবাদী করে তোলে। কারণ এর আগে সরকার ‘ডিজিটাল’ শব্দটি আইনের আগে বসানো হয়েছিল, যেটা যুক্তিযুক্ত ছিল না। কারণ ‘ডিজিটাল’ এবং ‘অ্যানালগ’ প্রযুক্তির দুটি ফরমেশন। আমরা অ্যানালগ ফরমেশন থেকে ডিজিটাল ফরমেশনে বা ডিজিটাল সার্ভিসে যাচ্ছি। এই কারণে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শিরোনাম এবং রূপরেখা দুটোই যুক্তিযুক্ত এবং দূরদর্শিতার পরিচয়।

প্রকৃতপক্ষে ‘অ্যানালগ’ এবং ‘ডিজিটাল’ এই দুটি ফরমেশনের ওপরই বিশ্বের সব প্রযুক্তি দাঁড়িয়ে আছে। ‘অ্যানালগ’ বাদ দিয়ে ডিজিটাল ফরমেশন তৈরি কিংবা ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

যেমন আমাদের স্মার্টফোন ডিজিটাল ডিভাইস, কিন্তু এই ডিভাইসে ঢুকতে গেলে আপনাকে অবশ্যই একটি অ্যানালগ সুইচ দিয়ে ঢুকতে হয়। আমরা যেসব সেন্সর ব্যবহার করি তাও অ্যানালগ। প্রযুক্তিগতভাবে সুইচ, সেন্সর কখনই, কোনোভাবেই ডিজিটাল ফরমেশনে হওয়া সম্ভব নয়। অতএব প্রযুক্তির একটি ফরমেশনকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো আইনের শিরোনাম হওয়া উচিত নয়। ‘অ্যানালগ নিরাপত্তা আইন’ যদি কোনো আইনের শিরোনাম হয়, সেটিও যেমন হাস্যকর হবে, তেমনি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ শিরোনামটিও যুক্তিযুক্ত নয়।

এবার সরকার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ শিরোনাম করার কথা জানিয়েছে। এইটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ আইন হয় একটি এলাকা, ভূখণ্ড এবং সেই এলাকার মানুষের জন্য। আমরা এখন যেমন মাটির উপরে দাঁড়িয়ে আছি, তেমনি সাইবার দুনিয়াতেও বিচরণ করছি। অতএব সাইবার স্পেসে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ শিরোনামটিই যুক্তিযুক্ত।

এখন দেখতে হবে পুরোনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার ক্ষেত্রে কী ধরনের ভুল ছিল। সাইবার নিরাপত্তা আইন তৈরির ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রথম ভুল ছিল সামাজিক অপরাধ এবং সাইবার অপরাধকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা। যে কারণে এই আইনটি সামগ্রিক অর্থে সাইবার অপরাধ দমনের আইন না হয়ে সংকীর্ণ অর্থে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানহানি প্রতিরোধের আইনে পরিণত হয়েছিল। আবার মানহানির সংজ্ঞা আইনে সুনির্দিষ্ট না থাকার কারণে আইনের অবাধ অপপ্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, যার প্রতিফলন বাস্তবে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন >>> গণমাধ্যম আইন : নিশ্চিত হোক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা 

অতএব সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথমেই সাইবার স্পেসে কোন বিষয়গুলো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেইগুলো সুনির্দিষ্ট করতে হবে। মনে রাখতে হবে সাইবার স্পেসে মৌলিক এবং প্রধান অপরাধ হচ্ছে হ্যাকিং।

হ্যাকিং ছাড়া সাইবার স্পেসে কোনো অপরাধ করা সম্ভব নয়। কোনো ওয়েবসাইটের দখল নেওয়া বলুন, ডিজিটাল ব্যাংকিং থেকে টাকা চুরি বলুন, কোনো ডিজিটাল ডিভাইস থেকে তথ্য চুরি বলুন, পাসওয়ার্ড চুরি বলুন সবকিছুই হ্যাকিং থেকেই শুরু হয়। হ্যাকিং সবাই করতে পারে না। এর জন্য যথেষ্ট প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন এবং তুখোড় বুদ্ধিমান হতে হয়।

তবে বুদ্ধিমান হ্যাকাররা আমাকে-আপনাকে আমাদের অজান্তেই তার হ্যাকিং টুলস বা মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই কারণে আইনে হ্যাকার এবং হ্যাকিং মিডিয়াকে পৃথকভাবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। একই সঙ্গে কতভাবে হ্যাকিং হয়, কোন ধরনের হ্যাকিংকে কোন মাত্রায় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে সেইসব বিষয়গুলো যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। 

আবার ‘নৈতিক’ ও ‘অনৈতিক’ হ্যাকার বলেও দুটো গোষ্ঠী আছে। নৈতিক হ্যাকাররা হ্যাকিং করে রাষ্ট্রকে, কোন প্রতিষ্ঠানকে কিংবা আমাকে-আপনাকে সচেতন করতে চায়। আর অনৈতিক হ্যাকরারা মূলত ব্ল্যাকমেইলার কিংবা হাইজ্যাকার। তবে আমার নিজের বিবেচনায় কোনো ধরনের হ্যাকিংই গ্রহণযোগ্য নয়।

যদি আমি কোনোভাবে বুঝতেই পারি কোনো সংস্থার সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল, তা আমি স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই সংস্থার সংশ্লিষ্টদের জানাতে পারি। এজন্য হ্যাকিং-এর নাটক করার দরকার কী? আসলে বিভিন্ন দেশ সাইবার যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবেই কিছু বেতনভুক্ত হ্যাকার রাখে। সমাজ এবং আইনের কাছে এই হ্যাকারদের ‘ইতিবাচক’ ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্যই ‘এথিক্যাল হ্যাকিং’ শব্দটির জন্ম হয়েছে।

আপনি চুরি প্রতিরোধের জন্য পেশাদার চোর পুষবেন এবং এটাকে ‘নৈতিক চুরি’ বলবেন এটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং অপরাধ দমনের জন্য, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যেমন রাষ্ট্রীয় বাহিনী গঠন করা হয়, সেইভাবে হ্যাকিং প্রতিরোধে যথাযথ প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন একটি কার্যকর সাইবার নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলাটাই যুক্তিযুক্ত।

অন্যান্য বাহিনীর মতোই এই বাহিনী আইন অনুযায়ী সাইবার স্পেসে অপরাধ দমন করবে, তেমনি সাইবার যুদ্ধের প্রয়োজন হলে যুদ্ধের নিয়মেই যুদ্ধ করবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠন করা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই এজেন্সিও যথাযথ ভূমিকায় আসতে পারেনি। অতএব সাইবার নিরাপত্তা আইনে প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর পরিবর্তে সাইবার স্পেসের বিষয়টি সামনে রেখে উপযুক্ত কাঠামোর সংস্থা গঠন এবং যথাযথ প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সেই সংস্থার নেতৃত্বে রাখা উচিত।

আরও পড়ুন >>> বায়াস, বুলশিট, লাই : আস্থার সংকটে সংবাদমাধ্যম 

প্রশ্ন উঠতে পারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য দিয়ে কারও মানহানি হলে (মিসেইনফরমেশন), কারও বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন (ডিজইনফরমেশন) করা হলে, ভুয়া খবর কিংবা গুজব ছড়ানো হলে সেইক্ষেত্রে কী হবে? এক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি। যে ব্যক্তি মানহানি করছে তিনি যদি দেশে বসবাস করা কেউ হন তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত ফৌজদারি আইনে মামলা এবং বিচার করা যায়। এক্ষেত্রে পেনাল কোডের যে ধারা প্রযোজ্য হবে সেইটি সাইবার নিরাপত্তা আইনে উল্লেখ করা যেতে পারে।

একটা সমস্যা হচ্ছে এমন ভুয়া তথ্য কিংবা গুজব ছড়ানো হয়, যেগুলো কয়েক মুহূর্তে সমাজে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এজন্য পেনাল কোডেই সংশোধনী আনা দরকার। সাইবার স্পেসে মিস ইনফরমেশন এবং ডিসইনফরমেশনকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে এ জন্য জরিমানা বা শাস্তির বিষয়টি আরও কঠোর করতে হবে।

আবার সাইবার স্পেসে বিদেশে বসে অপরাধ করতে পারে যে কেউ। সেটা হ্যাকিং হতে পারে, মানহানিকর মিথ্যা তথ্য পরিবেশন হতে পারে। এই অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাও খুব কঠিন কিছু নয়।

প্রথমত, যেসব দেশে বসে অপরাধীরা অপরাধ করছে বলে চিহ্নিত হচ্ছে সেইসব দেশের সঙ্গে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিট্যান্স ট্রিটি (এমলাট) [Mutual legal assistance treaty (MLAT)] করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অপরাধ দমনে এমলাট কার্যকর পন্থা হিসেবে স্বীকৃত।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমলাটের বিষয়টি ছিলই না। সাইবার নিরাপত্তা আইনে এমলাটের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। এমলাট থাকলে ফেসবুক কিংবা গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানকেও তাদের লাইসেন্স প্রদানকারী দেশের মাধ্যমে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব। একই সঙ্গে যারা প্রবাসী সাইবার অপরাধী তাদের ধরার জন্যও পেনাল কোডের কিছু ধারায় সংশোধনী আনা দরকার।

সাইবার অপরাধী প্রবাসীর ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য তার অভিভাবক, ভাইবোনকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয় এবং এটা ওই প্রবাসী সাইবার অপরাধীদের মতোই অসুস্থ চিন্তার প্রকাশ। বরং দেখা দরকার প্রবাসী সাইবার অপরাধীর দেশে কী ধরনের সম্পদ আছে।

আরও পড়ুন >>> অনলাইন সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ

কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আইনগত ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে। সেই ক্ষমতাই প্রয়োগ করা উচিত। এমনকি অপরাধীর বাবার সম্পত্তিতেও তার ‘অংশ’ আছে। ওই অংশটাকে আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র জব্দ করা উচিত। এজন্য যদি সংশ্লিষ্ট আইনের ধারায় সংশোধনী আনার দরকার হয়, আনতে হবে। তার শিক্ষাগত সব ধরনের সার্টিফিকেট বাতিল করতে পারে। একই সঙ্গে এমলাটের মাধ্যমে ওই প্রবাসী অপরাধী যে ধরনের অপরাধ করছে সেই সম্পর্কে এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে তার অবস্থান করা দেশের সরকার বা কর্তৃপক্ষকে যথাযথভাবে অবহিত করতে হবে।

সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোয় এত তুচ্ছভাবে বিবেচনা করা হয় কিংবা ধামাচাপা দেওয়া হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়, যে কারণে মানবাধিকারকে প্রাধান্য দেয় এমন উন্নত দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রে ওই অপরাধীদের মিথ্যা বক্তব্যকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। আর অপরাধীরা সেই সুযোগ নেয়।

সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধ করা জঘন্য অপরাধীও পশ্চিমের উন্নত দেশে নিশ্চিতে অবস্থান করতে পারে এবং অবলীলায় সরকারের বিরুদ্ধে শতভাগ নির্জলা মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতে পারে! অতএব সাইবার নিরাপত্তা আইনে মানবাধিকারের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে এবং এই আইনের অপপ্রয়োগকারীদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে উপযুক্ত শান্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে এই আইনে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

সবশেষে সংবাদপত্র এবং সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধান কী হতে পারে সেই প্রসঙ্গে আসি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় খুলনা-১ আসনের ফলাফল ঘোষণার সময় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজে ভুল তথ্য প্রচার করেছেন এবং তার সেই ভুল তথ্য প্রচারের জন্য সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পড়িয়েছেন।

প্রজাতন্ত্রের এই কর্মচারীই প্রথম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করে এই আইনকে বিতর্কিত করেছিলেন। সেই একই ধরনের বিধান সাইবার নিরাপত্তা আইনে থাকলে এই আইনটিও দ্রুত বিতর্কিত হয়ে পড়বে। আবার দেখা গেছে সংবাদপত্রে মুদ্রিত খবরের লিংক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করার জন্যও সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পড়েছে। এটিও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।   সাংবাদিকতা কখনোই অপরাধ নয়, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রমাণিত তথ্য যথানিয়মে প্রকাশ করা হলে এবং তা কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গেলেও অপরাধ বিবেচিত হতে পারে না।

আরও পড়ুন >>> গণমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক

কিন্তু বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের হীন ব্যবসায়িক স্বার্থে কিংবা সংবাদপত্র বা সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত কারও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারণে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা তথ্য প্রকাশ বা প্রচার অবশ্যই গুরুতর অপরাধ। এই ধরনের উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এটা দেশে স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য ভীষণ উদ্বেগের।

প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্টে সংশোধনী আনা দরকার। শুধুমাত্র ‘তিরস্কার’ নয়, আরও কঠোর বিধান থাকা উচিত। যদি কোনো রিপোর্টের সত্যতা প্রেস কাউন্সিলে চ্যালেঞ্জ হয় এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষ এবং সাংবাদিক প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যের সত্যতা প্রমাণে ব্যর্থ হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলই ফৌজদারি মামলারও সুপারিশ রতে পারে। এমন বিধানও করা উচিত। কিন্তু প্রকাশিত সংবাদের ক্ষেত্রে যা কিছু প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্টেই হবে, প্রেস কাউন্সিলেই হবে। সাইবার নিরাপত্তা আইনে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্টকেই ‘রেফার’ করা যেতে পারে।

শেষ পর্যন্ত আমরা আশাবাদী হতে চাই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত আর একটি বিতর্কিত আইন নয়, বরং সত্যিকার অর্থে একটি সময়োপযোগী, কার্যকর আইন হবে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩।  

রাশেদ মেহেদী ।। প্রেসিডেন্ট, টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক (টিআরএনবি)