বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন কেজরিওয়াল আসে না?
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ব্লুমসবুরি একটা বই ছাপে। বইয়ের শিরোনাম ‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল অ্যান্ড আম আদমি পার্টি—অ্যান ইনসাইড লুক’ (Arvind Kejriwal & the Aam Aadmi Party: An Inside Look)। লিখেছেন প্রাণ কুরুপ (Pran Kurup)।
কেজরিওয়ালকে লেখক খুব কাছে থেকে দেখেছেন ও মূল্যায়ন করেছেন। রচয়িতার আলোচনা তথ্যবহুল এবং বিশ্লেষণমুখী। তবে সাত বছর আগে প্রকাশিত বইয়ে লেখক কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিশেষ পূর্বাভাস দেননি। ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয় তিনি এড়িয়েই গেছেন। কেন এড়িয়ে গেছেন বোধগম্য।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কেন্দ্রে হোক বা প্রদেশে হোক, জনপ্রতিনিধিরা অল্প সময়েই অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা না থাকতে পারেন গণমুখী, না পারেন তাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখতে। অল্প সময়েই তারা গণশত্রুতে পরিণত হওয়ার মতো কাজকর্মের কমতি রাখেন না। তাই প্রাণ কুরুপও হয়তো উচ্চাশা বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে পরে ভুল প্রমাণিত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি।
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
আম আদমি পার্টি ভোটে জিতে এসে উত্তর প্রদেশে সরকার গঠন করে ২০১৩ সালে। সংক্ষিপ্ত প্রথম পর্বের শাসনকাল শেষে ২০১৫ সালে দ্বিতীয় দফায় দিল্লির পুনরায় সরকার গঠন করেন কেজরিওয়াল। লক্ষণীয়, আজ অবধি দিল্লির সরকার পরিচালনা করে গেলেও কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তায় তেমন ভাটা পড়েনি। বরং, জনপ্রিয়তা বাড়ন্ত।
দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিকদের, বিশেষত সরকার প্রধানদের ভাগ্যে এমন ব্যতিক্রম সচরাচর ঘটে না। এই রকম জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন আর মাত্র একজন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। শেষ দিকে এসে তিনি তার দলের শাসনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলেও ব্যক্তি ও জননেতা হিসেবে সম্মানিতই রইলেন। জনগণ আর তার দলকে ক্ষমতায় চায়নি বটে, কিন্তু তাকে সম্মানের আসনটি হারাতে হয়নি।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কেন্দ্রে হোক বা প্রদেশে হোক, জনপ্রতিনিধিরা অল্প সময়েই অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা না থাকতে পারেন গণমুখী, না পারেন তাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখতে...
কেজরিওয়াল ও বসু দুজনেরই কিছু অসামান্য গুণ রয়েছে। ব্যবহারিক ধরন-ধারণে সেইগুলো একই রকম না হলেও আমজনতার চোখে আরাধ্য। যেমন—সততা, স্বচ্ছতা, একাগ্রতা, আন্তরিকতা, অভিনিবেশ ও দৃঢ়চিত্ততা।
উভয়েরই এই গুণগুলো থাকার পরও কেজরিওয়াল অনন্য, অন্য একটি কারণে। তিনি বাম, ডান, মধ্যপন্থী, উদারবাদী, কট্টরবাদী, মৌলবাদী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক আদর্শিক রাজনীতির ফাঁদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। শুরুই করেছেন ‘সংস্কার’-এর দাবি দিয়ে।
আধুনিককালে উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি মূলত দলভিত্তিক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের রাজনীতি। ‘সমাজ-সংস্কার’ প্রসঙ্গ এই রাজনৈতিক কাঠামোয় সর্বৈব অনুপস্থিতই থাকে। নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে গৎবাঁধা প্রতিশ্রুতি হিসেবে থাকে দারিদ্র্য ও দুর্নীতি নির্মূলকরণের কথা। অনেকটাই কাজির গরুর মতো। কাগজে থাকলেও গোয়ালে থাকে না।
আরও পড়ুন >>> বিএনপি চা খেতে যাক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে
রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা পাওয়ার পর উল্টো নিমজ্জমান হয় দুর্নীতিতে। তাদের যুক্তি থাকে পার্টি চালানোর অর্থ সংস্থানের জন্য বিকল্পই বা কী!
দলীয় স্বার্থচিন্তার এই রকম জগদ্দল পাথর সরিয়ে আমজনতার একান্ত চাওয়া-পাওয়াকে আমলে নিতেই ভুলে যায় রাজনৈতিক দলগুলো। স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রসংস্কারে এগিয়ে আসবে—রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই রকম কিছু আর প্রত্যাশাই করা যায় না। অথচ আমজনতা চায় রাষ্ট্রসংস্কার, এক দল থেকে অন্য দলের হাতে ক্ষমতার হাতবদল নয়। এই চাওয়াটি স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল ২০০৬ সালে।
কেজরিওয়াল তুলে ধরলেন রাষ্ট্রে মহামারি রূপ ধারণ করা একটি অসুখের তাৎক্ষণিক নিরাময়ের কথা। বুঝলেন ও বোঝালেন তত্ত্বকথার ঝনঝনানি বা পলিটিক্যাল আইডিওলজি সবসময় দরকারি নয়। সময়ান্তরে রাষ্ট্রের পরতে পরতে যেসব অসুখ ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ে, সেইগুলোর সংক্রমণ থেকে স্বদেশ রক্ষা ও জনগণকে রক্ষা করাই বেশি জরুরি হয়ে পড়ে।
তিনি দক্ষ চিকিৎসকের মতো দুটি মহামারি রোগই চিহ্নিত করলেন। এক, সর্বব্যপ্ত দুর্নীতি। দুই, জনগণের কাছে জবাবদিহি না করার চর্চা। সব তথ্য জানতে পারা, কৈফিয়ত চাওয়া জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, কোনো সুযোগ নয়। রাজনীতিকরা জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য।
কেজরিওয়ালের এই সামাজিক সংস্কারমূলক অবস্থান দল-মত-ধর্ম ভাবনা নির্বিশেষে সব ভুক্তভোগী আমজনতার হৃদয়ের গভীরতর প্রদেশকে স্পর্শ করতে পেরেছিল। তারা দলে দলে অংশ নিয়েছিল তার আন্দোলনে।
সাম্প্রতিক প্রথাগত ক্ষমতার রাজনীতিতে সামাজিক সংস্কারের দায়বোধ তলানিতে অথবা একেবারেই গৌণ বিষয়। কেজরিওয়ালের আন্দোলন দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিল। সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সংস্কার আন্দোলন কতটা জরুরি মনে করিয়ে দিল।
...রাজনীতি শুধুই কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব চেনে। আমজনতার ভাবনার ছিটেফোঁটাও আর ধারণ করে না। না হয় বাংলাদেশে সীমাহীন দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কেজরিওয়ালের মতো একজন মানুষেরও উত্থান ঘটলো না কেন?
উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতকের সমাজ সংস্কারে সতীদাহ উচ্ছেদ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট, ব্রাহ্ম আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন ইত্যাদি সফল হয়েছিল রাজনীতিকে প্রভাবিত করেই। রাজনীতিকে সমাজবিচ্যুত হতে দেয়নি আন্দোলনগুলো।
আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি
কালের পরিক্রমায় উপনিবেশ-পরবর্তীতে রাজনীতি ক্রমেই সমাজ-সংস্কারবিমুখ ও ক্ষমতারোহণকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। বিংশ শতকে শুরু হওয়া এই অধঃপতনের ধারা একবিংশ শতকে এসে আরও জোরদার হয়। সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের বিযুক্তি এই উপমহাদেশে রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই অবস্থার কুফল দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা, দলীয় ভেদবুদ্ধি, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও হিংসা-হানাহানি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তিরোহিত হওয়া। ভ্রাতৃঘাতি রাজনৈতিক একদেশদর্শিতা ও ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও আক্রমণ কোনোটি নয়?
বাংলাদেশ বিষয়ে আমাদের গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ার কারণগুলো প্রতিদিনই বাড়ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন প্রায়। আমজনতা ভোটের অধিকারটুকু তো হারিয়েছেই, রাজনৈতিক সংঘাতের গভীর আতঙ্ক-আশঙ্কায়ও পড়তে হচ্ছে। কারণ একটিই। সমাজ-সংস্কারের চিন্তাবিযুক্ত ক্ষমতার রাজনীতি।
এই রাজনীতি শুধুই কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব চেনে। আমজনতার ভাবনার ছিটেফোঁটাও আর ধারণ করে না। না হয় বাংলাদেশে সীমাহীন দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কেজরিওয়ালের মতো একজন মানুষেরও উত্থান ঘটলো না কেন?
প্রতিবেশী দেশের কেজরিওয়াল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েও এই দেশের অন্তত একজন মানুষ পথে নামতে পারতেন। একজন পথপ্রদর্শক বা ভ্যানগার্ড পেলেই আমজনতা তার পেছনে জড়ো হতে পারতেন। তেমনটি কেন ঘটেনি? কারণ ডিভাইড অ্যান্ড রুল।
সূক্ষ্ম অপকৌশল দ্বারা আমজনতাকে দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংঘর্ষমুখী দলে বিভাজিত করে রাখা হয়েছে। এই রকম বিভাজিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় কে যায় বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে। বিশেষত ঘণ্টা বাঁধায় আগ্রহী যখন নিশ্চিত অরাজনৈতিক সমাজ সংস্কারে নামলেও তার ওপর হামলা-মামলার ও নির্যাতনের কোনো কমতি হবে না।
আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি
প্রাণ কুরুপের বইয়ের ভাষ্যে ফিরি। তিনি সমনোযোগ দেখিয়েছেন কেজরিওয়াল শুরুটি করেছেন স্টার্ট-আপ এর মতো। বিজনেস মডেলের স্টার্ট-আপ নয়, সমাজ সংস্কারের স্টার্ট-আপ। ভারতবর্ষে যত যাই ঘটুক গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখনো সুরক্ষিত।
আমজনতা বিভিন্ন দলের সমর্থক হলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এক। তারা বিভাজিত নয়। ফলে কেজরিওয়ালকে তারা ঠিকঠিক চিনেছে। অনুপ্রেরণার আধার ভেবেছে। অনতিবিলম্বে করণীয় বিষয়ে তাদের মাঝে কোনো বিভাজন নেই। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি তাদের অন্ধ ও হিংস্র করে দেয়নি। তার বিশ্লেষণ আমলে নিয়ে বাংলাদেশকে তুলনায় নিলে মেলে একেবারেই উল্টো চিত্র। এই কারণে সংস্কার আন্দোলনের অজস্র উপাদান ও সম্ভাবনা থাকার পরও আমাদের একজন কেজরিওয়াল পাওয়া হয়ে ওঠে না।
ড. হেলাল মহিউদ্দীন ।। অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়