যদি বলি যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ছোটখাটো একটা সংকটের মধ্যে আছে তাহলে সম্ভবত অতিশয়োক্তি হবে না। আমরা সবাই চাই যে দেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকুক যাতে করে জনগণ ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারে বা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে।

নির্বাচন ব্যবস্থা তো এখনো সংবিধানে আছে—কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে এই নির্বাচন ব্যবস্থাটা দেশের রাজনৈতিক দল ও গ্রুপগুলোর বড় অংশ যথাযথ বা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। গ্রহণযোগ্য মনে না করার জন্য ওদের পক্ষে কিছু কারণও রয়েছে যেগুলো আপনি একদম উড়িয়ে দিতে পারেন না।

আমাদের দেশে মাঝখানে কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের নির্দলীয় সরকারের অধীনে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান তুলে দেয়। বিএনপি এবং বিএনপির মিত্ররা দাবি করে আসছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। এই দাবির ভিত্তিতেই ওরা ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা মনে করে যে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। এবার তারা ঘোষণা দিয়েছে যে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে ওরা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা ছাড়াও দুই দলীয় বৃত্তের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোও ঐরকম নির্দলীয় সরকারকেই শ্রেয় মনে করে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে অবস্থান প্রকাশ করেছে। 

আমাদের দেশের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বা দৃশ্যপটটাই এইরকম যে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি মিলে দেশের মোট ভোটারদের কম বেশি ষাট থেকে সত্তর শতাংশের মতো প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এই দুই দলের একটি দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে নির্বাচন মোটামুটি এমনিতেই অনেকাংশে অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বা দৃশ্যপটটাই এইরকম যে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি মিলে দেশের মোট ভোটারদের কম বেশি ষাট থেকে সত্তর শতাংশের মতো প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এই দুই দলের একটি দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে নির্বাচন মোটামুটি এমনিতেই অনেকাংশে অর্থহীন হয়ে পড়ে।

বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আর মাস পাঁচেকের মধ্যেই, তখন নতুন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে যদি বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা অংশগ্রহণ না করে তাহলে সেই নির্বাচন আসলেই একটা অর্থহীন নির্বাচনে পরিণত হবে। যেরকম নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, ওরা আইনত হয়তো নির্বাচিত বলেই বিবেচিত হবেন, তবে সেই বিজয়ের পুর্ননৈতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কি না তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতেই পারেন।

এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারি দল অনড় বিদ্যমান সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে, বর্তমান সংসদ বিদ্যমান রেখে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন হবে, এর কোনো বিকল্প আওয়ামী লীগ ভাবতে রাজি নয়। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আওয়ামী লীগই আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠিত করেছি, তথাপি আওয়ামী লীগের এইরকম অবস্থান গ্রহণের পেছনে কারণ রয়েছে।

২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে, তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি-জামায়াত সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একরকম অপকৌশলের চেষ্টা করেছিল ফলে ২০০৬ সালের নির্বাচন ভেস্তে যায় আর দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে একটি আধা-সামরিক শাসনের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।

আওয়ামী লীগ সেই উদাহরণ দেয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে এইরকম ম্যানিপুলেশনের সুযোগ থেকে যায়। সাথে যোগ করে আমাদের আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অবৈধ ঘোষণা করার কথা।

আগামী নির্বাচনের আগে তো নয়ই, নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস, তারপরেও অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতেও কোনো সময় যে এই দুই মূল রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটা নির্বাচন পদ্ধতিতে একমত হবে সেই সম্ভাবনা আমি দেখি না। এর মধ্যে আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই রাজনৈতিক দল একসাথে আলোচনা করে কোনো বিষয়ে একমত হবে সেই সম্ভাবনা দূর হয়ে গেছে বলা যায়।

অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান যতদিন জীবিত আছেন আমার মনে হয় না ততদিন এই দুই দল কখনো একসাথে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে একমত পোষণ করবে। কেননা রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা ও সম্মানের যে মৌলিক প্রয়োজনীয়তাটুকু আছে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় সেটা সম্পূর্ণ ঘুচে গেছে। আপনি যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা ও আচরণ ইত্যাদি লক্ষ্য করবেন তাহলেই বুঝবেন ওদের মধ্যকার বৈরিতার তীব্রতা।

২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে, তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি-জামায়াত সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একরকম অপকৌশলের চেষ্টা করেছিল....

এই সংকট তাহলে কাটবে কীভাবে? যেভাবে চলছে তাতে করে এইরকম আশু কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না। ২৮ জুলাই ২০২৩, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলই ঢাকা শহরে বিশাল বিশাল জনসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। তার আগে ১৮ জুলাই ২০২৩ পদযাত্রা আর শোভাযাত্রা পালন করল দুই দল। তারও আগে ১২ জুলাই ২০২৩, দুই দল আলাদাভাবে একদফা ঘোষণা করেছে। এতে জনগণের লাভ কি হয়েছে?

আমরা আশা করছি দুই দল আরও সমাবেশ করবে। সমাবেশ বা পাল্টাপাল্টি সমাবেশে কোনো সংঘর্ষ যেন না হয়—কিন্তু একই দিনে দুই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির ফলে নগরে এবং সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, নগরে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।

যেহেতু জামায়াত এখন বিএনপির সাথে এইসব কর্মসূচিতে থাকছে না, আশা করছি যে সেই রকম খারাপ কোনো সন্ত্রাস, নৈরাজ্য বা ব্যাপক সংঘর্ষ হবে না। তবে ব্যাপক আকারে না হলেও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ তো হতেই পারে। এইসব নিয়ে গোটা দেশের মানুষই উদ্বিগ্ন থাকবে। দুই দলের নেতারাও জানেন এই বাস্তবতা, কিন্তু তবুও তারা একই তারিখে, একইরকম কর্মসূচিই দিতে থাকবেন। এইটাই হচ্ছে ওদের মনোভাবের প্রকাশ-যেখান থেকে আপনি উপসংহারে আসবেন, এই দুই দল মিলে আলাপ আলোচনাও হবে না, কোনো সমাধানও হবে না।

তাহলে আশু সমাধান কীভাবে হবে? এই অধম কোনো আশু সমাধান দেখে না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় যেটা মনে হয় শেষ মুহূর্তে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে এইবারও একইরকম একটা একপাক্ষিক নির্বাচন হয়ে যাবে আর আওয়ামী লীগ তার মিত্রদের নিয়ে ক্ষমতায় থেকে যাবে।

বিএনপির নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারবেন না। অনানুষ্ঠানিকভাবে আপনি পরিচিত পরিমণ্ডলে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে পারেন, আমি যেটা দেখেছি, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বেশকিছু সংখ্যক নেতা ইতিমধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দিয়েছেন। পূর্ণ একটা গণতান্ত্রিক বিধান প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের লড়তে হবে আরও অনেক দিন।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট