ছবি : সংগৃহীত

কয়েক বছর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল। ধরুন কোনো একটা দলের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি ছিল। তো, কর্মসূচি শেষ হলে হরতাল আহ্বানকারী দলের বক্তব্য হতো—এই হরতাল সর্বাত্মকভাবে সফল করায় জনগণকে ধন্যবাদ।

উল্টোদিকে হরতালের বিপক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলের বক্তব্য—অযৌক্তিক হরতাল প্রত্যাখ্যান করায় জনগণকে অশেষ ধন্যবাদ। অর্থাৎ দুই পক্ষেরই দাবি জনগণ তাদের সঙ্গে আছে। কিন্তু আদতে জনগণ কী ভাবছে, সেই খবর কে নিয়েছে কবে?

প্রায় টানা দেড় বছর আন্দোলনের পর বিএনপি ১২ জুলাই সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেছে। পল্টন কার্যালয়ের সামনের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব একদফা ঘোষণার পাশাপাশি নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করেন। ১৮ জুলাই পালিত হলো রাজধানী ঢাকার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পদযাত্রা কর্মসূচি। একইদিন, অর্থাৎ ১২ জুলাই আওয়ামী লীগ সমাবেশ করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ প্লাজায়। আওয়ামী লীগও পাল্টা একদফা ঘোষণা করে। তাদের একদফা হলো—যেকোনো মূল্যে সুষ্ঠু নির্বাচন।

আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি 

সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপি যেদিন ঢাকা জুড়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছে, একইদিন আওয়ামী লীগ রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের সামনে শান্তি সমাবেশ এবং সমাবেশ শেষে রমনা থেকে ধানমণ্ডি পর্যন্ত উন্নয়নের শোভাযাত্রা করে। যথারীতি দুই দলেরই দাবি জনগণ নিজেদের পক্ষে আছে, অপরপক্ষের কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু অতি জনসংখ্যা, অতি ঘনবসতি, অতি ট্রাফিক জ্যাম এবং অতি দূষণের ঢাকা নগরে একই দিনে দুটি প্রধান দল রাস্তাঘাট দখল করে কর্মসূচি পালন করলে জনগণের অবস্থা কী হয়, সেটি কি তারা জানেন না, বোঝেন না?

অবশ্যই জানেন এবং বোঝেন। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বোধহয় এখানে রাজনীতি করতে হলে সব ধরনের বিবেচনাবোধ ভুলে গিয়ে উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজতে হয়। তা না করলে বোধহয় রাজনীতির ময়দানে ইজ্জত থাকে না।

কীসের জন্য বিএনপির এই আন্দোলন? নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবে। বিএনপির ভাষায় ২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত অনেকেই। কিন্তু একটু পেছনে ফিরলে দেখা যায়—এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিতর্কিত করেছে বিএনপিই। আঁতকে উঠবেন না, বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি।

১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-২ আসনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান। ১৯৯৩ সালের দিকে তার মৃত্যু হলে আসনটি শূন্য হয়। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ এই আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আসাদুজ্জামানের ছেলে শফিকুজ্জামান বাচ্চু।

আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি

বিএনপির প্রার্থী হন কাজ সলিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল। সেই নির্বাচনে কারচুপির সবমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। একটি হোন্ডা তিনটি গুণ্ডা হলে নির্বাচনে জয় সম্ভব—এমন স্লোগান নিয়ে মাঠে নামেন বিএনপি নেতারা। উপনির্বাচন পর্যবেক্ষণে গিয়ে হেলিকপ্টারে ফিরে আসতে বাধ্য হন তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, দুই দলের মধ্যে পাহাড় সমান দূরত্ব, একে অপরের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস এবং দ্বন্দ্ব—এসব প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হতে পারে?

২১ মার্চ মাগুরা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের ভোট-ভাতের অধিকার আদায়ের ঘোষণা দেন। শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন।

সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মুখেও জামায়াত সমর্থিত তৎকালীন বিএনপি সরকার কান দেয়নি। বরং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক তরফা নির্বাচন করে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন অব্যাহত রাখলে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে পদত্যাগে বাধ্য হয়।

১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে একুশ বছর পর সরকার পরিচালনায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর পর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। লতিফুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা হয়েই বদলি করে দেন ১৩ জন সচিবকে। শেরে বাংলা নগরে জনসভা শেষ করে গণভবনে গিয়েই শেখ হাসিনা দেখতে পান—কেটে দেওয়া হয়েছে টেলিফোন লাইন। অথচ তখনো প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্তই হননি।

২০০১ সাল। ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। মেয়াদ শেষের দিকে এসে শুরু হয় সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ। সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা, বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করার তোড়জোড়। ২০০৪ সালের ১৬ মে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সাদামাটা বিষয়ে কেন সংবিধান সংশোধনী, প্রশ্ন উঠতে থাকে বিভিন্ন মহলে।

আরও পড়ুন >>> বিএনপি চা খেতে যাক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। অভিযোগ ওঠে শুধুমাত্র বিএনপির পছন্দমতো ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতেই বাড়ানো হয় বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা।

২০০৩ সালের জুন মাস। প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তাকে করা হয় দেশের ১৩তম প্রধান বিচারপতি। কে এম হাসান একসময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এতেই স্পষ্ট হয় হয়ে ওঠে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্যে। যেন কে এম হাসান অবসরের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন। এর ফাঁকে নতুন ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটার করা, বিতর্কিত বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার।

এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে তৎকালীন সংসদে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সবকিছু তোয়াক্কা করে বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের পরিকল্পনামাফিক। এক পর্যায়ে প্রবল আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান কে এম হাসান। শুরু হয় নতুন বিতর্ক।

সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে আগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এছাড়া চারটি বিকল্প ছিল সংবিধানে। সবকিছু পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। দায়িত্ব নেওয়ার পর ইয়াজউদ্দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। পদত্যাগ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৪ উপদেষ্টা। শুরু হয় নতুন সংকট।

সবকিছু উপেক্ষা করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন ইয়াজউদ্দিন। রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়তে বাধ্য হন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা।

দৃশ্যপটে সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে গঠিত আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে।

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নিয়ে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় ২ বছর। চলতে থাকে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার নানা ষড়যন্ত্র। দুর্নীতির মামলা দিয়ে প্রথমে জেলে পাঠানো হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। এরপর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঠানো হয় কারাগারে।

পরস্পরের প্রতি এই রাজনৈতিক অবিশ্বাস, চরম বৈরী মনোভাব—এসব কিন্তু জনগণ তৈরি করেনি। করেছে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই। সুতরাং এর সমাধান তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। জনগণ গণতন্ত্র চায়, ভোট-ভাতের অধিকার চায়।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। হাইকোর্টে ওঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল চেয়ে করা রিট। হাইকোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চের দুইজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত দিলেও, ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে এই ধরনের ব্যবস্থায় বিচার বিভাগকে না জড়ানোর পক্ষে মতামত দেওয়া হয়। রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা করেছিল বিএনপি। পরে কারচুপি করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের কব্জায় নেওয়ার অপচেষ্টা করেছিল দলটি। কিন্তু কথা এখানেই শেষ হয় না।

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিতর্কিত করেছিল, ঠিক আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কী করল? মাথাব্যথার জন্য ওষুধ না দিয়ে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, দুই দলের মধ্যে পাহাড় সমান দূরত্ব, একে অপরের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস এবং দ্বন্দ্ব—এসব প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হতে পারে?

আরও পড়ুন >>> জোশের লাগাম টানতে হবে 

২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বরং নির্বাচন প্রতিহতের নামে জ্বালাও পোড়াও করেছে। কিন্তু ২০১৮ সালে সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আশ্বাসে অংশ নিয়ে যে ফল হলো, তাতে করে বিএনপি আবারও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে কীসের আস্থায়? সুতরাং তারা আন্দোলনের মাঠে। দাবি কতটুকু আদায় করতে পারবে—তা পরের প্রশ্ন। কিন্তু বিএনপির এই লাগাতার আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচি—সব মিলিয়ে যে জনভোগান্তি হচ্ছে—তার প্রতিকার কী?

মনে রাখবেন, পরস্পরের প্রতি এই রাজনৈতিক অবিশ্বাস, চরম বৈরী মনোভাব—এসব কিন্তু জনগণ তৈরি করেনি। করেছে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই। সুতরাং এর সমাধান তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। জনগণ গণতন্ত্র চায়, ভোট-ভাতের অধিকার চায়। কিন্তু কিছুতেই রাজনৈতিক আন্দোলন পাল্টা আন্দোলনে চিড়েচ্যাপ্টা হতে চায় না।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি