ছবি : সংগৃহীত

১২ জুলাই সকালে নাস্তার টেবিলে বললাম, আজ ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। বড় দুই দলই মিটিং ডেকেছে। অপ্রয়োজনে কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়। মুক্তি বললো, দুই দলকেই একদিনে মিটিং করতে হবে কেন? একদল আজকে করুক, আরেকদল পরে করুক। তাহলেই তো মানুষের দুর্ভোগ কম হয়।

আমি বললাম, এটা ওবায়দুল কাদেরকে জিজ্ঞাসা করো। বিএনপি সমাবেশ ডাকলেই আওয়ামী লীগ পাল্টা শান্তি সমাবেশ ডাকে। বিএনপি সমাবেশ প্রত্যাহার করলে, আওয়ামী লীগও প্রত্যাহার করবে।

আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করবে, সরকার পতনের দাবিতে মিছিল-সমাবেশ করবে; এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি 

বিএনপি আইনের বাইরের কিছু করলে সেটা দেখার জন্য আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। আওয়ামী লীগের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব বেশি। কিন্তু বিএনপি কোনো কর্মসূচি ডাকলেই আওয়ামী লীগকে তার পাল্টা কর্মসূচি ডেকে জনগণের ভোগান্তি ডাবল করতে হবে কেন? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।

আওয়ামী লীগ ডাকে ‘শান্তি সমাবেশ’, কিন্তু একই দিনে দুই দলের কর্মসূচি থাকলে দুই দলের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকেন, তাতে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ে। শান্তি সমাবেশের নামে অশান্তির আশঙ্কা বাড়ায় আওয়ামী লীগ।

যেহেতু বিএনপির কর্মসূচি ফলো করে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করে, তাই উসকানির দায়টা আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। ১২ জুলাই বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসতে চেয়েছেন, সরকার নানাভাবে তাদের আসার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।

বিএনপি এক দফা ঘোষণা করেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। আর আওয়ামী লীগের এক দফা হলো, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন।

আমরা দেখেছি, ২০২২ সালে দেশের বিভিন্নস্থানে বিভাগীয় সমাবেশের সময় সরকার বা সরকারি দল কৌশলে পরিবহন ধর্মঘট ডাকার ব্যবস্থা করে সমাবেশে লোক সমাগম কমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সব বিভাগীয় সমাবেশেই বিপুল লোকসমাগম হয়েছে। সরকারের বাধার কারণেই বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা বেশি ছিল।

আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি

বিএনপির পাল্টা কর্মসূচির যুক্তি হিসেবে সরকারি দলের নেতারা বলেন, বিএনপিকে মাঠ ছেড়ে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে ইত্যাদি। সবই ঠিক আছে। কিন্তু একই দিনে কর্মসূচি ঘোষণা মানেই তো রাজনৈতিক মোকাবিলা নয়, এটা স্পষ্টতই উসকানি।

বিএনপি ১ লাখ লোকের সমাবেশ করলে আওয়ামী লীগ দুইদিন পর ২ লাখ লোকের সমাবেশ করে তার জবাব দিতে পারে। একই দিনে সমাবেশ করা মানেই রাজনৈতিক জবাব নয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, ১২ জুলাই আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের চেয়ে বিএনপির সমাবেশে লোক সমাগম অনেক বেশি হয়েছে। একই দিনে সমাবেশ ডেকে তো আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জবাবের চেয়ে রাজনৈতিক পরাজয় বেশি হয়েছে।

১২ জুলাই রাজপথে যানবাহন চলাচল কম ছিল। সাধারণ মানুষ ভয়ে রাস্তায় বের হয়নি। কিন্তু সবার তো আর ঘরে বসে থাকার উপায় ছিল না। যারা বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন, তাদের অনন্ত ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

গুলিস্তান বা মতিঝিল থেকে হেঁটে মিরপুর বা মোহাম্মদপুরে ফিরতে হয়েছে অনেক মানুষকে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় মুখে জনগণের কল্যাণের কথা বলেন। কিন্তু কার্যত তারা জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলেন। জনগণের দুর্ভোগ যত বেশি, কর্মসূচি যেন তত সফল।

আরও পড়ুন >>> বিএনপি চা খেতে যাক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 

মির্জা ফখরুল বলেছেন, তাকে কাকরাইল থেকে হেঁটে নয়াপল্টনের সমাবেশে যেতে হয়েছে। কিন্তু যাদের মতিঝিল থেকে হেঁটে মিরপুর যেতে হয়েছে, তাদের কথা কি তিনি একবারও ভেবেছেন?

অনেকদিন ধরে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতো ছুটির দিন। কিন্তু এবার সেই নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। বুধবার অফিসের সময়েই রাজপথ ছিল রাজনীতিবিদ ও নেতাকর্মীদের দখলে। হঠাৎ কেন এই ব্যতিক্রম? কারণ এখন বাংলাদেশে আছেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ সফর করছে। বিএনপি আসলে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তাদের শক্তি দেখাতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগও পাল্টা নিজেদের শক্তি দেখাতে চেয়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নই মুখ্য, জনগণ নয়।

বিএনপি এক দফা ঘোষণা করেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। আর আওয়ামী লীগের এক দফা হলো, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন। তার মানে একদলের লক্ষ্য হলে ক্ষমতায় যাওয়া, আরেক দলের লক্ষ্য হলো, ক্ষমতায় টিকে থাকা।

জনগণ চায় স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, বাজারে পণ্যের ন্যায্যমূল্য এবং ভোট দেওয়ার অধিকার। সেই ব্যাপারে সরকারি বা বিরোধী দলের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না...

এখানেও জনগণের কোনো ভূমিকা নেই, কোনো মতামত নেই। যারা জনগণের কথা বলে রাজনীতি করছেন, তারা কি একবারও জনগণের কাছে জানতে চেয়েছেন, জনগণের দফা কী, তাদের চাওয়া কী?

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

জনগণ চায় স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, বাজারে পণ্যের ন্যায্যমূল্য এবং ভোট দেওয়ার অধিকার। সেই ব্যাপারে সরকারি বা বিরোধী দলের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বাজার দর আকাশ ছুঁয়েছে, তা নিয়ে সরকারি দলেরও কোনো মাথাব্যথা নেই, বিরোধী দলেরও কোনো কর্মসূচি নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ সবাই যেভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে; তাতে আগামী নির্বাচনে কারো পক্ষেই ইচ্ছেমতো খেলার সুযোগ নেই।

২০১৪ বা ২০১৮ স্টাইলের নির্বাচন বাংলাদেশে আর হবে না এটা নিশ্চিত। এখন রাজপথে পাল্টাপাল্টি কাদা মাখামাখি বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বসে একটা উপায় ঠিক করতে হবে—কীভাবে একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ