বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি কি অর্থনীতির ভীতি কাটাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ হলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। মুদ্রানীতি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করে। দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সুদের হার এবং অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে এটি ব্যবহৃত হয়।
২০২৩ সালের ১৮ জুন, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর জন্য ‘মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট’ অর্থাৎ মুদ্রানীতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক যা ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে মুদ্রানীতি প্রকাশ করেছে যখন অর্থনীতিতে চরম অস্থিরতা বিদ্যমান। মূল্যস্ফীতির আস্ফালনে দিশেহারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ হার ও মজুদের পতন দৃশ্যমান। প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সংকট চলমান। বাণিজ্যে ঘাটতি ও মুদ্রা পাচার তো রয়েই গেছে। তাছাড়া, সামনে জাতীয় নির্বাচন। আর নির্বাচন মানে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার আশঙ্কা।
আরও পড়ুন >>> মূল্যস্ফীতির গতি ও অর্থনীতির প্রকৃতি
অর্থনীতির বর্তমান সমস্যাগুলোর মধ্যে নীরব ঘাতক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার। সরকার কোনোভাবেই এটাকে বাগে আনতে পারছে না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০২৩ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বর্তমানে এই হার হয়তো আরও বেশি। যদিও ২০২২ সালের বাজেটে প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা কখনোই ধরে রাখা যায়নি।
তবে, নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ লক্ষ্য অর্জনের আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও আইএমএফ অনুমান করছে যে, ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে প্রায় ৯ দশমিক ১ শতাংশে।
ঘোষিত মুদ্রানীতি অনুযায়ী ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ শতাংশ ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ সমন্বয় করে সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারণ করতে পারবে। ছয় মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদ ৭ দশমিক ১৩ শতাংশে থাকার কারণে নতুন নীতিমালায় ব্যাংক ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
অর্থনীতির বর্তমান সমস্যাগুলোর মধ্যে নীরব ঘাতক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার। সরকার কোনোভাবেই এটাকে বাগে আনতে পারছে না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০২৩ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ছাড়াও ভোক্তা ঋণের তদারকি খরচ বাবদ প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ১ শতাংশ বেশি সুদ ধার্য করতে পারবে। কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হবে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে ২ শতাংশ সুদ যোগ করে। ক্রেডিট কার্ডের সুদহার আগের মতোই ২০ শতাংশ। ‘সিক্স মানথ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ বা স্মার্ট রেফারেন্স রেট প্রতি মাসের প্রথম কার্যদিবসে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তাছাড়া, নীতি সুদের হার অর্থাৎ রেপো হার ৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে এবং রিভার্স রেপো হার ৪ দশমিক ২৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয় অন্যান্য ব্যাংকগুলো।
স্পেশাল রেপো সুদহার ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো এই বিশেষ সুবিধা পায়। এখন থেকে নীতি সুদের হারের করিডোর প্রথায় অর্থাৎ সাড়ে ৬ শতাংশ নিম্নসীমা ও সাড়ে ৮ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমার মধ্যেই কলমানিতে লেনদেন করতে হবে ব্যাংকগুলোর। নতুন নিয়মে কোনো সুদ আরোপ করার পর ৬ মাসের মধ্যে বাজার সুদহার পরিবর্তিত হলেও ব্যাংক গ্রাহকের সুদের হার পরিবর্তন করতে পারবে না।
আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
তবে, আমানতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার কত হবে তা এবার মুদ্রানীতিতে বলা হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিপূর্বে ব্যাংকগুলোর তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির হারের ঊর্ধ্বে আমানতের সুদের হার নির্ধারণের নির্দেশনা দিয়েছিল যা এখনো বর্তমান। যাই হোক, অবশেষে অর্থনীতির বেসামাল মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে বাজার সুদের হারের সীমা তুলে দিয়ে বাজার ভিত্তিক সুদের হার প্রচলন করা হয়েছে মুদ্রানীতিতে।
তাছাড়া, নীতি সুদহারের করিডর প্রথা, ডলারের একক দাম ও রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নের প্রবর্তনসহ বেশকিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক যা আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণেরই অংশ ছিল।
তাই, অনেক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইএমএফের ঋণের শর্তের চাপেই বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে বাধ্য হয়েছে। কেননা, কিছুদিন আগেও বলা হচ্ছিল যে, আমাদের মূল্যস্ফীতি সরবরাহে ঘাটতিজনিত সমস্যা। তবে, এখন ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, মুদ্রানীতি আইএমএফের শর্ত মেনে করা হয়নি। অনেক দেশ এই পদ্ধতিতে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, নতুন মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা কতটুকু সম্ভব? এই নীতি অনুযায়ী ঋণ সুদের হার বৃদ্ধি করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হচ্ছে। তবে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা বলছে, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরঞ্চ, সুদের হার অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ১০ মার্চ ২০২৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক এবং এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ ১২ মার্চ ২০২৩ নিউইয়র্ক ভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংকের পতন ঘটে।
এর মধ্যেই বিশ্বের অন্যতম ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিস বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ক্রেডিট রেটিংয়ের অবনমন দেখিয়েছে। স্থায়ী অবস্থান থেকে নেতিবাচক অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছে। এতে করে, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের ব্যাংকেগুলোর কার্যক্রম করতে বেশি খরচ বহন করতে হবে।
আরও পড়ুন >>> নির্বাচনী বছরে বাজেটে বাজিমাত কতটুকু সম্ভব?
তাছাড়া, ঋণ সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। বিশেষ করে, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণবঞ্চিত হবে। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাত নির্ভর। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে কথা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে তা অর্জন কখনো সম্ভব হবে না।
জানুয়ারি-জুন প্রথম ছয় মাসের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু বিনিয়োগ খরায় সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করে ১১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।
দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাত নির্ভর। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে কথা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে তা অর্জন কখনো সম্ভব হবে না।
বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ কমালেও সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য আরও বাড়ানো হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ যা জুন পর্যন্ত ছিল ৪০ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা বলেছে সরকার।
দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দৃশ্যমান বিধায়, পূর্বের অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণের জোগান দিয়েছে এডিপিতে খরচ করার জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বের অর্থবছরে বাজারে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এই কারণে বাজার থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা উঠে এসেছে। সেই কারণে, বাজারে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়।
আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : ইতিহাস যা বলে
চলতি বছরেও সরকারি ঋণ বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে। পূর্বের অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই বিল-বন্ড কিনে নেওয়ার মাধ্যমে সরকারকে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা জোগান দিয়েছে। একদিকে যেমন বেসরকারি খাতে ঋণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে; আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছেপে বাজারে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি করছে। কাজেই, এইরকম বিপরীতমুখী ব্যবস্থার কারণে নতুন মুদ্রানীতি অনুযায়ী বাজারে সামগ্রিক ঋণ নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়।
তবে, আমানতের সুদের হার একই সাথে বৃদ্ধি পেলে জনগণ ব্যাংকে আরও সঞ্চয় জমা রাখতে উদ্ভূত হবে। এতে হয়তো তারল্য সংকট কিছুটা কমবে। কিন্তু ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ঋণের পরিমাণও যদি কমে যায় তখন, ব্যাংকগুলোর অলস অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে, ব্যাংকগুলোর মুনাফাও কম আসতে থাকবে এবং ব্যাংকগুলো আরও সংকটে নিমজ্জিত হবে।
পরিশেষে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিনিময় হারের চাপ, বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের পতন, লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্যসংকট ও অন্যত্র উচ্চ সুদহারের বিষয়গুলো বিবেচনা করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিবেচিত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত। অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে উল্লেখিত বিষয়গুলোর ব্যাপ্তির আশু সংকোচন প্রয়োজন। তবে, এই মুদ্রানীতি কতটুকু সফলতা বয়ে নিয়ে আসবে বা আমাদের অর্থনীতির ভীতি প্রশমনে কতটুকু সাহায্য করবে তা নির্ভর করবে এর সঠিক ও সময়মতো দক্ষ প্রয়োগের ওপর।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়