ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম-দুর্নীতি
ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩-এর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি। এতে বলা হয়েছে, খেলাপি হলে অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে অন্য কোনো ব্যাংক খেলাপির অনুকূলে নতুন ঋণ ইস্যু করতে পারবে না।
এছাড়া ব্যাংকের পরিচালক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হলে তার পদ শূন্য হবে। পাশাপাশি অর্থ আদায়ে খেলাপি পরিচালকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে ব্যাংক। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিজ্ঞাপন
আইন অনেক এবং অনেক কঠোর। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নীতি যদি এমন হয় যে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসে কেউ নয়ছয় করলে তাকে ধরা হবে না, সেইক্ষেত্রে আইন করে কিছু হবে না। তারই কিছুটা আভাস পাওয়া গেল একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, এক ঋণখেলাপির বেনামি কোম্পানিকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। ইতিমধ্যে বেনামি ওই কোম্পানিকে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের বনানী শাখা। এখন নতুন করে আরও ২০ কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
আরও পড়ুন >>> সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি!
অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের হেমলেট টাওয়ারে অবস্থিত গ্লোবাল করপোরেশনস নামের একটি কোম্পানিকে নথিপত্র যাচাই বাছাই ছাড়া ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক বনানী শাখা।
এই প্রতিবেদনে একজন ব্যক্তির নামও উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার প্রোফাইল দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি অতি ক্ষমতাধর। ব্যাংক খাতে যা ঘটছে তা এক কথায় অভাবনীয় পদ্ধতি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যেকোনো প্রক্রিয়ায় ঋণ নেওয়া, ফেরত না দেওয়া, এই খেলাপিদেরই আবার ঋণ দেওয়া বা দিতে ব্যাংকগুলোর ক্ষমতা কাঠামো থেকে চাপ দেওয়া, এই পুরো চিত্রটি আমরা ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি বলে হালকা করে রেখেছি, আসলে তা এক বিরাট ব্যাংক দুর্নীতি।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যেকোনো প্রক্রিয়ায় ঋণ নেওয়া, ফেরত না দেওয়া, এই খেলাপিদেরই আবার ঋণ দেওয়া বা দিতে ব্যাংকগুলোর ক্ষমতা কাঠামো থেকে চাপ দেওয়া, এই পুরো চিত্রটি আমরা ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি বলে হালকা করে রেখেছি, আসলে তা এক বিরাট ব্যাংক দুর্নীতি।
কোনো বিশেষ ব্যবসায়ী ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ অর্থ বেআইনিভাবে ঋণ পাইয়ে দেওয়া এবং সেই ঋণ ফেরত না পাওয়ায় এই বিপুল ঋণ ব্যাঙ্কটির অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়। স্বেচ্ছা খেলাপি এবং ঋণ প্রতারকদের বিষয়ে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের উচিত নিয়ম ও নীতি নৈতিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু সেই নিয়ম নৈতিকতাই আজ উধাও।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। জানা গেল, আবুল কাশেম ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার শুরুতেই দুর্নীতি করেছেন।
আরও পড়ুন >>> যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক পতন ও আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ
টাকার অঙ্কে তার দুর্নীতি অর্ধসহস্রাধিক কোটি টাকা হবে। কিন্তু ব্যাংকের কোনো কোনো পরিচালক কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তারা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশীর্বাদ নিয়ে একটি ব্যাংক থেকেই ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোর মালিকরাই পুরো আর্থিক খাত পরিচালনা করছেন। সরকার বরং আইন করে মালিকদের জমিদারির মেয়াদ বর্ধিত করছেন।
দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আর আসবেই না, এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ঋণ খেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া, মালিকদের পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী করাসহ সব আয়োজন বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী করায়ত্ত করেছে।
খারাপকে শাসন করতে হয়, শাস্তি দিতে হয়, ভালোকে পুরস্কৃত করতে হয়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম, এটাই সুশাসন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এর বিপরীতটাই চলছে।
আরও পড়ুন >>> ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি
খারাপদের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা দেখানোর ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করে, অনেক লড়াই সংগ্রাম করেও যে সুবিধা পায় না, সেই সুবিধাই ঋণখেলাপিদের উপহার দিচ্ছে এই সিস্টেম।
ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন কিছু ব্যাংক মালিক ও শীর্ষ খেলাপি। এই শীর্ষ খেলাপিদের কেউ কেউ এখন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণী জায়গায় থেকে নিজেদের মতো একটা আর্থিক সংস্কৃতি তৈরিতে সক্রিয় আছেন। ফলে ঋণ জালিয়াতির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঘটছে একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা।
কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কেলেঙ্কারির কথা উঠতে উঠতেই জানা যাচ্ছে অন্য কোনো ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য। যারা এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় না আনার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে মানুষকে।
হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য এখন জনগণের মুখে মুখে। কিন্তু অবস্থা বদলাচ্ছে না। ক্ষমতার জোর এমনই যে চাল নেই চুলো নেই এমন কোম্পানিও ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ পাচ্ছে।
আরও পড়ুন >>> জনগণের টাকায় আনন্দ উল্লাস!
আমরা মনে করি, দেশের সুশাসনের একটি বড় সূচক হলো অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করা। এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঞ্চল্যকর ব্যাংক ও আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রতি প্রশ্রয়মূলক মনোভাব আমাদের হতাশ করেছে।
ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা আর সরকারি ব্যাংকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি আর বাড়তে না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আইন অনুযায়ী তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেওয়া উচিত।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন