ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের উন্নয়ন একটি মহলের কাছে বিভ্রম বা ভ্রান্তি। সেই ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা অনেক গবেষণা করে আবিষ্কার করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া দেশটি চিরকাল পরনির্ভর থাকবে। উন্নত বিশ্বের দয়ায় বেঁচে থাকবে। যদি কোনো কারণে দেশটি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, যদি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে তাহলে ধরে নিতে হবে দুনিয়ার যেকোনো দেশ উন্নত হবে।

অলৌকিক কাণ্ড ছাড়া এটা সম্ভব হবে না, এটাও তারা বলে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও এটা মনে করতেন। তিনি ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের বাঙালি নিধনযজ্ঞে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি শত্রু গণ্য করতেন এবং ১৫ আগস্টের ঘাতকদের তিনি মদদ দিয়েছিলেন, এমন অভিযোগ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই অমূলক মনে করেন না। কেউ আর পশ্চাৎপদ থাকবে না।

সত্যিই যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে উন্নয়নশীল দেশের সম্মান পাওয়ার মতো অবস্থায় চলে গেল তখন কেউ বা বলা শুরু করল এ এক প্রহেলিকা বা হেঁয়ালি কিংবা ধাঁধা। তারা মাথার চুল টেনে অস্থির পদচারণা করতে করতে বলেন—সব ঝুটা, সব ঝুটা।

আরও পড়ুন >>> আমেরিকার প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য কতটা উপকারী? 

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ? নিজের অর্থে পদ্মা সেতু? যমুনায় রেল সেতু? ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ? ঢাকার বুকে মেট্রোরেল? কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে প্রশস্ত সড়ক পথ? এক যুগের বেশি সময় ধরে কোটি কোটি স্কুল ছাত্রছাত্রীদের সরকারি ব্যয়ে পাঠ্যবই প্রদান? নিশ্চয়ই বাঁশ ব্যবহার হয়েছে রডের পরিবর্তে, কিংবা সিমেন্টের বদলে দেওয়া হয়েছে মাটি। এদের কাছে বাস্কেট কেস ও তলাবিহীন ঝুড়ি মুখরোচক শব্দ হয়ে উঠেছিল।

বাংলাদেশে আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞা’—এটিও এই মহলের কাছে মুখরোচক শব্দ। কত যে চর্চা চলছে ‘বিশেষজ্ঞ’ মহলে। মনে হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সর্বক্ষণ ঢাকায় এদের কাছে ফোন করে জানতে চান—কী করবেন এবং কী করবেন না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়—ভারত, চীন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেরও উচিত তাদের পরামর্শ মেনে কাজ করা কিংবা না করা।

আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী পর্যায়ের কেউ বাংলাদেশ সফরে এলে তারা অবলীলায় শীতেও ‘লু বা গরম হাওয়া’ বইয়ে দিতে পারেন কিংবা জাতীয় মর্যাদার তোয়াক্কা না করে বলতে পারেন—রেজিম চেঞ্জ এক্সপার্ট আসছেন বাংলাদেশে, এইবার শেখ হাসিনার রক্ষা নাই। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ থেকে যেন কর্মী নেওয়া না হয়, তার জন্য অপচেষ্টায় ঘাটতি নেই এই মহলের।

বাংলাদেশের কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশের আইজিপি থেকে থানার ওসি, রাজনৈতিক নেতা—কে কে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না পাওয়ার দলে—একটি মহল তা ‘ফাঁস করে দিচ্ছে’ প্রতিদিন। কিছুদিন আগে জানা গেল—বিএনপি নামের দলটি সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ-র‌্যাবের সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে দেওয়ার জন্য।

তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বলছে—আপনাদের কথামতো যদি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে না চায়, যদি বাংলাদেশের স্থল বা জলসীমায় সামরিক স্থাপনার প্রস্তাবে রাজি না হয়—তাহলে ভিসা প্রদান না করার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দিন, যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যেসব বাংলাদেশি কষ্ট করে আয়ের পর কিছু ডলার স্বদেশে স্বজনদের কাছে পাঠায় তা বন্ধ করে দিন।

আরও পড়ুন >>> কূটনীতির নতুন মাত্রা 

এতেও যদি কাজ না হয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাতের জন্য যেমন বঙ্গোপসাগরে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিলেন, তেমন কোনো পদক্ষেপ নিন।

ক্ষমতার জন্য একটি মহল নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করতে দ্বিধা বোধ করে না—এটা জানা আছে। মানবজমিন পত্রিকায় ২০২৩ সালের ৫ জুলাই বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন রেখেছিল—যুক্তরাষ্ট্র ‘ভিসা নীতি’ বাস্তবায়ন করতে অনেক সমস্যায় পড়বে। বিশেষ করে তাদের বাংলাদেশ দূতাবাসে লোকবলের অভাব। তাদের পক্ষে সব ধরনের ডকুমেন্টস সংগ্রহ করা কঠিন। এর উত্তরে বিএনপির নেতা বলেছেন—ভিসা নীতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রকে সব ধরনের সহায়তা দিতে বিএনপি প্রস্তুত। এমন ফ্রি অব কষ্ট বা বিনা পয়সার অফার আমেরিকা কোনো দেশ থেকে কি পেয়েছে? নাকি গিভ অ্যান্ড টেক কাজ করছে—তোমরা কিছু পাবে, আমরা বিনিময়ে কিছু দেব, প্রয়োজনে উজাড় করে দেব।

এটাও হতে পারে—বিএনপি নিছকই বাগাড়ম্বর করছে, প্রহেলিকা বা ধাঁধা সৃষ্টি করতে চাইছে। শেখ হাসিনাকে সহায়তাকারী সরকারি অফিসার ও পুলিশের তালিকা হচ্ছে—এটা রটিয়ে দিয়ে তাদের মনোবলে সামান্যও যদি চিড় ধরানো যায়, সেটাই লাভ।

অর্থনীতির ক্ষতি করাও মতলব হতে পারে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার শঙ্কায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যদি স্বাভাবিক কাজ না করে কিংবা কাজে ঢিলা দেয়, তাহলে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে এবং বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে কৃষি ও শিল্প খাতে।

কূটনৈতিক অঙ্গনেও প্রভাব পড়তে পারে। বিএনপি গুজব-মিথ্যাচার-বিভ্রান্তি সৃষ্টির একটি নেটওয়ার্ক দাঁড় করিয়েছে, যা বাংলাদেশের বাইরেও সক্রিয়। কোরবানির সময়ে একটি ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হলো—‘ঢাকার রাস্তায় রক্তের স্রোত’। করোনার সময় প্রচার হয়েছিল—লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে, দাফন করার লোক পাওয়া যাবে না। নেত্র নিউজ ২০২০ সালের ২১ মার্চ জানিয়েছিল—Bangladesh is facing up to two million deaths from the COVID-19 epidemic if immediate steps are not taken to suppress the virus, a leaked inter-agency UN memo has warned.

সংবাদ-সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল কয়েকটি বিশ্বখ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থার। এর মধ্যে ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানও ছিল। কিন্তু এই সংস্থা পরে জানায়—এমন গাঁজাখুরি কিছু তারা প্রকাশ বা প্রচার করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভিসা নীতির’ বরাত দিয়ে একটি মহল যা করছে তাকে ‘গাঁজার নৌকা পাহাড় ডিঙিয়ে যায় অবলীলায়’-বৈ কিছুই বলা যায় না।

কুচক্রী মহলটি আগামী নির্বাচন টার্গেটে রেখেছে, সন্দেহ নেই। ২০২২ সালের অক্টোবরে তারা বলেছিল—১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় চলবে বাংলাদেশ। এরপর সাত মাস চলে গেছে, তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়নি। তারা ভেবেছিল—শেখ হাসিনা থাকছেন না, খালেদা জিয়া আসছেন, সেটা প্রচার হলেই প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যরা দলে দলে বিএনপির ঝাণ্ডা তুলে ধরবে এবং নির্বাচনে বিএনপির হয়ে কাজ করবে।

আরও পড়ুন >>> বীরের জাতি বাঙালি 

এখন নতুন প্রচার—ভিসা নীতির ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে চায় না, বিএনপিকে চায়। জাতিসংঘ, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কেউ বাংলাদেশে এলেও তারা রব তোলে—এইবার শেখ হাসিনার রক্ষা নাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও তাদের পুলক জাগে—‘দুই নেতা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন।’

তাদের কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে গুজব-গালগল্পের শেষ নেই। সেখানে জো বাইডেনের হালুম ধ্বনি শুনে নরেন্দ্র মোদি কীভাবে মেকুরে পরিণত হয়েছিলেন, এমন ‘প্রত্যক্ষদর্শীর’ বিবরণ জানা গেছে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এই আলোচনায় শেখ হাসিনাকে ‘সেফ এক্সিট’ প্রদানের বিষয়টিও উঠেছে বলে আমাদের জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে ভিসা নীতি বাস্তবায়নে ফ্রি-সার্ভিস প্রদানে অতি উৎসাহী মহলটি। অথচ কে না জানে, এই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সেফ-এক্সিট সুবিধার কাঙাল ছিলেন না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও সাত নভেম্বরের চরম দুঃসময়ের পর শত শত আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে কাটিয়েছেন, অনেকে নির্বাচন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সহ্য করেছে, যেদিন তারেক রহমানের পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সব কেন্দ্রীয় নেতাদের একসঙ্গে হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা হয়েছিল।

ওয়ান ইলেভেনের পর ২০০৭ সালের মে মাসে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের বাইরে রাখার চক্রান্ত হয়েছিল। তিনি জেলের ঝুঁকি নিয়ে স্বদেশে ফেরেন। কিন্তু তারেক রহমান ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের সেফ এক্সিট সুবিধা মেনে নিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। খালেদা জিয়াও ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে শেখ হাসিনার সেফ এক্সিট সুবিধা মেনে নিয়ে কারাগারের পরিবর্তে নিজ বাসায় থাকতে পারছেন।

যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ। অসীম সামরিক শক্তিধর দেশটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্য। কূটনীতির অঙ্গনে তাদের গুরুত্ব বাংলাদেশ উপলব্ধি করে। আমেরিকা বোমারু বিমান উড়িয়ে কোনো দেশকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ড ঘটালে পাহাড়ের ওপর উঠে লাঠির খেলা দেখিয়ে তাদের ঘায়েল করা যাবে না, সেটা বাংলাদেশ জানে।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

তারা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক দেশকে চাপ দেয়, রেজিম চেঞ্জের চেষ্টা করে (বহু বছর মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ে রেজিম চেঞ্জের জন্য ঘোষণা দিয়েই রাষ্ট্রনেতাদের হত্যা করেছে বা তার চেষ্টা করেছে)—এটাও আমাদের জানা। তবে এটাও জানা যে তারা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতো রাজনৈতিক নেতাদের তরফে ফ্রি সার্ভিসের অফার এলেই লুফে নেওয়ার মতো অপরিপক্ব নয়। তাদেরও হিসাব-নিকাশ থাকে।

শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশকে কতটা বদলে দিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের সারিতে নিয়ে যাওয়ার অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছেন, সেই খবর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তাদের না জানালেও সত্য জানার সূত্র অবশ্যই জানা আছে।

অজয় দাশগুপ্ত ।। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা