প্রান্তিক নারীর ঈদ অর্থনীতি
প্রান্তিক শব্দটার মধ্যে অনেক দূরের কিছু বা সীমান্তবর্তী ব্যাপার আছে, শুনলেই মনে হয় এলাকাটা সুবিধাবঞ্চিত। যেখানে পৌঁছানো সম্ভব না। পৌঁছাতে চাইলেও নিশ্চয়ই পায়ে কাঁটা বিঁধবে। একইভাবে প্রান্তিক থেকে কেউ মেইনস্ট্রিমে উঠে আসতে চাইলেও তাদের দফা রফা হয়ে যাবে কিংবা করা হবে। তবে আশার কথা হলো আমাদের দেশটাই প্রান্তিক জনপদের দেশ এবং আমরা কোনো না কোনো উপায়ে আসলে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অর্থাৎ ফেসবুকনির্ভর ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা মাত্র তিনবছর আগেও প্রান্তিক নারীদের কাছে সেইভাবে পরিচিত ছিল না। অথচ এখন তাদের প্রত্যেকের হাতেই ইন্টারনেট সুবিধা। আছে ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক আর ইউটিউবের বদৌলতে সারা দেশব্যাপী পণ্য বিপণন ও বাজারজাতকরণের সুযোগ।
বিজ্ঞাপন
কেবল গ্রামকেন্দ্রিক বাণিজ্যের মধ্যে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি। এখন কথা হলো পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে প্রান্তিক নারীদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জায়গাটা কতখানি প্রসারিত হয়েছে? উত্তরটা সন্তোষজনক না হলে দ্রুত বের করা উচিত ঘাটতির জায়গাটা আসলে কোথায়!
আরও পড়ুন >>> মহররম থেকে দুর্গোৎসব : সম্মিলন ও শক্তি
ঈদ মানেই বিশাল আয়োজন। ঈদের বিরাট বাজারে প্রবেশ করতে চাইলে যে পরিমাণ সংগ্রাম করতে হবে তার জন্য প্রান্তিক জনপদের সাবেকি কর্মদক্ষতা আদৌ প্রস্তুত আছে কি না! কারণ; অনলাইন আধিপত্যের আগে প্রান্তিক নারীদের ব্যবসায়িক চাহিদা ও জোগান ছিল একেবারেই সরলতর একটা অধ্যায়।
মোটা ভাত আর মোটা কাপড়ের প্রান্তিক সংস্কৃতির ভেতরে থেকে নারীরা সবসময় নিজেদের আরও বাড়তি খানিকটা আদরে রাখতে চেয়েছে। হয়তো সেই জন্যেই পুরুষ প্রধান পারিবারিক কাঠামোতে নারীদের মুখ্য ভূমিকা সংসার দেখভাল ও সন্তান লালনপালন হওয়া সত্ত্বেও তারা চেয়েছে নিজের হাতে কিছু টাকা থাকুক।
পারিবারিক অসময় ও অর্থনৈতিক সংকটকালে ক্ষুদ্র আয়ের সেই নারীই যে উদ্ধারকারী জাহাজ সেটাও আমাদের সবার জানা! তবে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের যেটা জানা নেই তাহলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রান্তিক নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে বেশি।
টাকার হিসাব পরিবারের প্রধান পুরুষ সদস্যটি না জানুক এবং টাকাটা খরচ করলে সেটার তদারকি কেউ না করুক অর্থাৎ তারা চেয়েছে তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আয়ের জায়গায় যেন জবাবদিহিতাহীন একটা সুখবস্থান থাকে। তাদের হাতে টাকা আসার বিষয়টা হয়তো স্বাবলম্বিতার খাতিরে কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তির তাগিদে নয়।
প্রান্তিক নারীরা এত কঠিন শব্দের অর্থ যেমন বোঝে না, তেমনই বোঝে না সহজ বিষয়কে কঠিন করে ভাবতে। তবে মোটাদাগে উদ্দেশ্য হলো নিজের পছন্দমতো চুড়িমালা কেনা এবং সন্তানকে একটা বল কিংবা পুতুল কিনে দেওয়ার মতো বায়না পূরণ করতে যাতে করে টাকাটা পরিবারের পুরুষের কাছে চাওয়া না লাগে।
এছাড়া পারিবারিক অসময় ও অর্থনৈতিক সংকটকালে ক্ষুদ্র আয়ের সেই নারীই যে উদ্ধারকারী জাহাজ সেটাও আমাদের সবার জানা! তবে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের যেটা জানা নেই তাহলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রান্তিক নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন >>> ঈদ আনন্দ : আসুক সবার ঘরে
প্রান্তিক অর্থনীতির চাকা যাদের হাতে তাদের আসলে সেই দায়িত্ব পালনের সঙ্গতি কতখানি! হাত খরচের টাকা উপার্জনের জন্য তারা সাধারণত কী কী করে থাকে? প্রথমত সহজতর উপায় বাড়ির উঠানে হাঁস মুরগি পালন ও সবজি চাষাবাদ করে। একটু অর্থবান গৃহস্থ বাড়ির বউ হলে পরিসর আরেকটু বাড়িয়ে গরু ছাগল লালনপালন করে।
আর গ্রামীণ জনপদের নারীদের অনন্য দক্ষতা হিসেবে সূচিকর্ম তো আছেই! সেইসাথে আরও আছে পাড়াপড়শির জন্য টেইলারিং সার্ভিস। গ্রামীণ এইসব সংস্কৃতির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো সংসারের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদনকৃত বাড়তি কৃষিপণ্য তারা বাজারে নয়, পাড়াপড়শির কাছে বিক্রি করে থাকে।
বাজার চাহিদা নিয়ে যেমন তাদের কোনো ভাবনা ছিল না, ন্যায্য দামে পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিয়েও তাদের সম্যক ধারণা নেই। সুতরাং প্রান্তিক জনপদের ঘরে ঘরে নারীদের ক্ষুদ্র ব্যবসার খাত ও পরিধি বিস্তার লাভ করলেও ব্যবসার কাঠামোগত বিচ্যুতির কারণে সেইসব খাত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেনি।
নারীদের প্রথম ও প্রধান অন্তরায় হলো সামাজিক অবমূল্যায়ন। নারীকে তার পণ্যের বিপরীতে কম দাম দেওয়া যায়, নারীকে তার সার্ভিসের বিপরীতে কম মজুরি দেওয়া যায়, অজ্ঞতার কারণে তার ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেওয়া যায়...
এক্ষেত্রে নারীদের প্রথম ও প্রধান অন্তরায় হলো সামাজিক অবমূল্যায়ন। নারীকে তার পণ্যের বিপরীতে কম দাম দেওয়া যায়, নারীকে তার সার্ভিসের বিপরীতে কম মজুরি দেওয়া যায়, অজ্ঞতার কারণে তার ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেওয়া যায়। তবে এইসব কিছুর ব্যাপক একটা পরিবর্তন আনা সম্ভব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।
সুতরাং নারীদের হাত ধরে প্রান্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সংস্থা বাজার চাহিদার ভিত্তিতে তাদের বিভিন্ন খাতে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে। খাতগুলোর অধীনে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু আসলেই কি এই প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধার ফলে তারা স্থানীয় বাজার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে?
আরও পড়ুন >>> উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি
প্রশিক্ষণ পরবর্তী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যেসব কাঠামোগত সাপোর্ট দরকার হয় তার জোগান আদৌ কি প্রান্তিক নারীদের কাছে সহজলভ্য! ঈদ পার্বণকে কেন্দ্র করে দেশে ফ্যাশন ও ভোগ্যপণ্যের পণ্যের বিশাল একটা চাহিদা তৈরি হয়। পণ্যের সেই চাহিদার ভিত্তিতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইলে দরকার হয় দক্ষ কর্মী, কাঁচামাল, বিপণন কৌশল, সহজলভ্য ডেলিভারি সার্ভিস ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া।
প্রান্তিক ঈদ অর্থনীতি মূলত মার খেয়ে যায় এইখানে। কারণ; প্রান্তিক নারীরা বেসিক প্রশিক্ষণ ও পণ্য বিপণনের ডিজিটাল সুবিধাদি পাওয়া সত্ত্বেও প্রান্তিকতার ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারবে না যদি না তাদের জন্য কাঠামোগত সাপোর্ট সিস্টেমগুলো রেডি থাকে! যদিও যুগান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি এবং সব রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে এমন দুইজন চারজন মানুষের দেখা সবসময় পেয়ে যাবেন। সেটা যৌক্তিক উদাহরণ নয়।
সামগ্রিক প্রান্তিক নারীদের নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রমের জন্য দরকার সহজলভ্য সাপোর্ট সিস্টেম। চাই প্রয়োজনীয় সব সুবিধাদি নারীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাক এবং প্রান্তিক শব্দটা অচিরেই বিলুপ্ত হোক।
ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার-ই ট্রেড