ছবি : সংগৃহীত

নেতাদের পুকুরচুরি থেকে শিল্পপতিদের ঋণখেলাপি, ছোট-বড়, চুরি-ডাকাতি থেকে কেনাবেচায় কর ফাঁকি, হরেক রকম দুর্নীতি ঘটেই চলেছে চারপাশে। কর ফাঁকি দেওয়া, সরকারের চোখে ধুলা দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার বিপরীত চিত্রটা হলো অতি দরিদ্র মানুষেরা বিদেশ থেকে টাকা দেশে আনেন।

২০২৩ সালের জুন মাসের প্রথম ২৩ দিনে মে মাসের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে বাংলাদেশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি জুন মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসীরা ১৭৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। কারণ হলো ঈদ।

এই উৎসবে দেশে থাকা প্রিয়জনেরা যেন ভালো থাকেন তার জন্য নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে বাড়তি আয় করে প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন যেমনভাবে সবসময় পাঠান উৎসবে, পার্বণে।

আরও পড়ুন >>> অবৈধ অভিবাসন : আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা 

প্রবাসে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা বারবার বিপন্ন হয়েছে। তারা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন, কখনো রোগে শোকে, কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে, কখনো নিয়োগকারীর নিপীড়নে। কিন্তু শত কষ্ট হলেও তারা দেশে থাকা স্বজনদের খুশি রাখতে চান এবং তার বড় প্রকাশ দেখা যায় উৎসব এলে। তারা দেশে থাকা স্বজনদের নিরাপদে রাখতে দুর্যোগে নেমে পড়েন।

আমরা অনেক উন্নয়ন করেছি, আমাদের নানাবিধ প্রণোদনায় ব্যবসার নামে অনেকে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির যে খাত নিয়ে আমরা গর্ব করি, তা হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে যারা পাড়ি দেন বিদেশে তারাই টিকিয়ে রেখেছেন অর্থনীতিকে।

প্রবাসে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা বারবার বিপন্ন হয়েছে। তারা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন, কখনো রোগে শোকে, কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে, কখনো নিয়োগকারীর নিপীড়নে। কিন্তু শত কষ্ট হলেও তারা দেশে থাকা স্বজনদের খুশি রাখতে চান...

একটু ভালো থাকার জন্য তারা বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকেন, বৈরী পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জনের প্রায় পুরোটাই দেশে থাকা পরিবারের ভরণপোষণের জন্য পাঠিয়ে দেন এবং উৎসব বা পার্বণে বা দেশে যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে তখনো তারা দূর থেকে রসদ জুগিয়ে যান।

আমাদের বড়লোকদের বিলাসিতা অনেকটাই নির্ভর করে এই প্রবাসীদের ওপর ভরসা করে। তারা সাধ্যমতো হাসিমুখে তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যান পরিবার ও দেশকে।

প্রবাসীরা পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অকাতরে সব দান করেন। দেশে ফেলে আসা পরিবারই তার জীবন। জীবনের সব উপার্জন দিয়েও নিজের বা পরিবারের জন্য কোনো স্থায়ী সংস্থান করতে পারেন না বেশিরভাগ প্রবাসী। কিন্তু প্রবাসীদের এই অবদান কেবল পরিবারের জন্য নয় আসলে, এর মাধ্যমে বড় অবদান তারা রাখছেন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে।

আরও পড়ুন >>> বৈষম্যই যখন নিয়তি 

প্রবাসীর কষ্ট প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বোঝে না। একদিকে শারীরিক শ্রম অন্যদিকে মানসিক কষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের দরিদ্র প্রবাসীরা অতি নাজুক ও বৈরী পরিবেশে কাজ করেন। প্রবাসীদের জীবন পরিচালিত হয় ত্যাগ ও বিনিময়ের মাধ্যমে।

যারা বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরতে বিদেশ যান কাজ করতে, তাদের বড় অপূর্ণতা হলো জীবনকে ঠিকমতো বুঝতে পারার আগেই জীবনের দাবি মেটাতে নেমে পড়তে হয় কাজে এবং সেটাও নিজ ভূমিতে নয়। বৈরী আবহাওয়া ও সামাজিক ভুবনে।

আমি অনেক ভালো ছাত্রকে দেখেছি পড়ালেখা ছেড়ে প্রবাসে শ্রমিকের জীবন বেছে নিয়েছেন পরিবার বাঁচাতে। লেখাপড়ার এই অপূর্ণতা তাকে সারাজীবন কষ্ট দিয়ে যায়। অল্প বয়সে বিদেশে চলে যাওয়ার আরেকটি বেদনা হলো বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যে বন্ধু উচ্চতর লেখাপড়া করছে, চাইলেও আর সাথে বন্ধুত্ব টিকে না। যে সময় খেলার মাঠে বা আড্ডায় থাকার কথা সেই সময় প্রবাসে চলে আসায় অন্তরে রক্ত ক্ষরণ চলে দীর্ঘ সময় ধরে। বাবা-মা বা পরিবারের আপনজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়াও তাকে নিয়ত মানসিক যন্ত্রণায় রাখে।

যে সময় খেলার মাঠে বা আড্ডায় থাকার কথা সেই সময় প্রবাসে চলে আসায় অন্তরে রক্ত ক্ষরণ চলে দীর্ঘ সময় ধরে। বাবা-মা বা পরিবারের আপনজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়াও তাকে নিয়ত মানসিক যন্ত্রণায় রাখে।

বিবাহিতদের মধ্যে যারা প্রবাসে যান তাদের কষ্ট আরও বেশি। স্ত্রী ও সন্তান ছেড়ে প্রবাস জীবন ভয়ংকর কষ্টের একদিকে তাদের দেখতে না পারা, অন্যদিকে বিদেশে থাকা অবস্থায় দেশে স্ত্রী ও সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে এক প্রকার ট্রমার মধ্যেই দিন কাটে তাদের। যাদের বাড়িতে শুধু বৃদ্ধ বাবা-মা থাকেন তারাও মানসিক যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করেন।

এমন অসংখ্য বেদনা বুকে নিয়ে প্রবাসীরা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অন্য দেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। উৎসবের রং তাদের জীবনকে রাঙায়িত করতে না পারলেও তারা রাঙিয়ে যান আমাদের।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি লোক দেশের বাইরে থাকেন। বড় অংশ থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং তারা মূলত দরিদ্র প্রবাসী শ্রমিক। এই প্রবাসীরা দেশে যে টাকা পাঠান তার বড় অংশ জীবনের ব্যয় নির্বাহ এবং ভোগ বিলাসে ব্যয় হয়। আর বিনিয়োগ হয় কম। বিনিয়োগ বলতে কিছু জমিজমা কেনা, ঘরবাড়ি বানানো ও ফ্ল্যাট কেনা ইত্যাদি।

প্রবাসী আয়ের বিনিয়োগ কীভাবে হতে পারে তার চেষ্টা থাকা উচিত সরকারের। সেটা হলে দেশে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। প্রবাসীরা এখন সরাসরি বন্ড কিনতে পারেন। এই স্থায়ী আমানতও এক ধরনের বিনিয়োগ। তাদের আয়ের ওপর প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের। কিন্তু তারা যেহেতু দেশে থাকেন না তাই জমিজমা কেনা আর ঘরবাড়ি বানানো ছাড়া অন্য কোনো বিনিয়োগের কথা তারা ভাবতে পারেন না।

প্রবাসীরা সাধারণ মানুষ। ফলে তারা প্রচলিত বিনিয়োগে গিয়ে প্রচলিত জটিল রজনীর ও গ্রাম্য পরিস্থিতিতে টিকতে পারেন না। তবু তারা আছেন, তারা উৎসবে পার্বণে দুর্যোগে নিজেদের সবটুকু দিয়ে আমাদের জীবনের সবখানে আছেন।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন