ছবি : সংগৃহীত

বেপরোয়া ড্রাইভিং’ বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানির প্রধান কারণ এবং এই বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য প্রধানত মাদকাসক্তিকে দায়ী করা হয়। প্রতি বছরই ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস’ পালিত হয়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দেশে বন্ধ হচ্ছে না মাদক ব্যবহারের ফলে সড়কে দুর্ঘটনার মত ভয়াবহ ঘটনা। নেশাগ্রস্ত কিংবা ঘুমকাতুরে হয়ে গাড়ি চালানোর জন্যও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।

দূরপাল্লার যানবাহনের চালকদের মধ্যে বড় একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের মাদক গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যাই বেশি। অনেকেই গাঁজা ও ফেনসিডিলে আসক্ত। নাম পকাশ না করার শর্তে আসক্ত একাধিক চালক জানান, তারা নেশা করে গাড়ি চালান ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্য নিয়ে।

২০১৬ সালের আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আয়োজনে ‘মাদকাসক্তি ও সড়ক দুর্ঘটনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিলের তথ্যমতে জানা যায়, গাড়িচালকদের মাদক সেবনের কারণে ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর ৯৮ শতাংশ চালক কোনো না কোনোভাবে মাদক গ্রহণ করেন। ৫০০ জন বাস ও ট্রাকচালকের ওপর জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে বলে তারা জানান।

আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালকদের ডোপ টেস্ট (মাদক পরীক্ষা) অনেকটাই বাধ্যতামূলক। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। বৈশ্বিক বিবেচনাতেও প্রথম সারির দিকে অবস্থান বাংলাদেশের। সড়ক দুর্ঘটনার নেপথ্যে অন্যতম কারণ হলো চালকের মাদকাসক্তি।

চালকদের বড় অংশই মাদকাসক্ত। ২০০৭ সালে ব্র্যাকের রোড সেফটি কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ভারী যানবাহন (বাস-ট্রাক) চালকদের প্রায় ৬৯ শতাংশ মাদক সেবন করেন। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী, মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক মোটরযান চালালে ৩ মাসের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ঢাকায় কমপক্ষে ৫০ হাজার গণপরিবহন চালক ও তাদের সহকারীরা মাদকাসক্ত। ক্রমাগত ক্লান্তি ও বিষণ্নতায় বেশিরভাগ চালক ও চালকের সহকারীরা (হেলপার/কন্ডাক্টর) ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন করে থাকে।

আরও পড়ুন >>> আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন 

বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন। এসব কারণের মধ্যে মাদক গ্রহণ করে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, জরাজীর্ণ সড়ক, অযোগ্য যানবাহন, অদক্ষ চালক, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব অন্যতম।

২০২০ সালের ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটার একটি ধাপ বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে, তা ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত করা প্রয়োজন।

চালকদের মাদকমুক্ত থাকতে হবে। এই ব্যাপারে গাড়ির মালিকদেরও সচেতনতার প্রয়োজন। নিয়োগ দেওয়ার সময় তাদের নিশ্চিত হতে হবে চালক মাদক সেবন করে কি না।

একইসঙ্গে, শ্রমিক, মালিক, যাত্রী সাধারণ সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিশেষ করে, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে পেশাদার চালকদের দক্ষতা উন্নয়ন ও তাদের মাদক এবং ক্ষতিকর নেশামুক্ত করতে হবে। সড়কে মানুষের জীবনের সুরক্ষায় কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়া উচিত হবে না।

আরও পড়ুন >>> রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত? 

চালকদের মাদকাসক্তি চিহ্নিত করতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে বাড়াতে হবে কঠোর নজরদারি। কোনো যানবাহন যদি সড়কে অস্বাভাবিক চলাচল করে তাহলে সেই গাড়ি থামিয়ে চালকের ডোপ টেস্ট করতে হবে।

মাদকাসক্তির পরীক্ষা শুরু হলেই অন্যরাও সতর্ক হয়ে সুপথে ফিরবে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেশা আসক্ত চালকদের চিহ্নিত করার জন্য উন্নত বিশ্বে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তা আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

তরিকুল ইসলাম ।। অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন