অসুন্দরের বিরুদ্ধে চলুক সাংস্কৃতিক লড়াই
কোনো কোনো শহরে খুব ঘন ঘন যাওয়া পড়ে। এমন কেন হয় জানি না। যাওয়া হচ্ছে না বলে, মনের ভেতর যে তাড়া বা আফসোস জিইয়ে রাখি, সেটি যখন ভেঙে যায়, দেখি ঐ শহরে যাওয়া এক প্রকার অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়। এর ভালো দিক হলো, শহরকে বহুমাত্রিকভাবে দেখা যায়।
এমনও শহর আছে, যেখানে কুড়ি বছর ধরে যাচ্ছি। নিয়মিতই যাওয়া হচ্ছে। দেখা গেল কুড়ি বছর পর ঐ শহরের কোনো গাছ, পুকুর বা শিঙাড়ার দোকানের সঙ্গে পরিচয় হলো। আস্ত একটা মহল্লাই হয়তো দেখা হয়নি। তাই যখন যে শহরে যাই সেই শহরকে চেটেপুটে নিংড়ে দেখে নিতে চাই। এই চাওয়ার বড় কারণ হলো সংস্কৃতিকে জানা। শহরের যাপন কেমন করে বদলে যাচ্ছে সেটা চোখে লিখে রাখা।
বিজ্ঞাপন
কত কিছুইতো চোখে টুকে রেখেছি। পাল্টে উল্টে দেখি। সংস্কৃতির সুর জেলা-উপজেলা বা মফস্বল শহরগুলোয় কেটে গেছে। এই সুর কেটে যাওয়ার সঙ্গে বাজারের যোগ আছে। রোজগারের সাথে আছে আত্মীয়তা। রোজগারের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে মানুষের হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি বা গিটারে আঙুল ছোঁয়ানো হয় না।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
পরীক্ষা চক্রে সন্তানদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শিল্পকলার সঙ্গে তাদের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা হয়েছে। যতটুকু ‘আর্ট-কালচার’ সেইটুকু বিদ্যালয়ের লোক দেখানো পাঠ্যক্রম বা আয়োজন। কিন্তু শিল্প চর্চাতো শুধু বিদ্যালয়ের ওপর ভরসা করে চলেনি কখনো।
সংস্কৃতির সুর জেলা-উপজেলা বা মফস্বল শহরগুলোয় কেটে গেছে। এই সুর কেটে যাওয়ার সঙ্গে বাজারের যোগ আছে। রোজগারের সাথে আছে আত্মীয়তা...
শিল্পের অনুশীলন এগিয়ে গেছে সংগঠনের হাত ধরে। ছোট ছোট শহরেও প্রতি পাড়ায় সংগঠনের চঞ্চলতা দেখা যেত। দিবস পালন ছাড়াও তাদের সাপ্তাহিক-মাসিক আয়োজন, অনুশীলন থাকতো। গান, আঁকা, নাচ, নাটক নিয়ে সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনের সেকি তুমুল লড়াই। এই লড়াই চলতো শৈল্পিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মেজাজে।
শহর ঘুরতে ঘুরতে তিন দশকে দেখছি সংগঠনগুলো বিলুপ্ত প্রায়। অনেক পুরোনো সংগঠন খুঁজেও পাই না। কোনো কোনো সংগঠনের নামফলক দেখি। কিন্তু দপ্তরে দোকান বা অন্য অফিস হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি—সংগঠন যারা পরিচালনা করতেন, তাদের বয়স হয়ে গেছে এখন আর আগের মতো সক্রিয় থাকতে পারছেন না।
আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
কোনো কোনো সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া মানুষেরা শহর ছেড়ে চলে গেছেন। সংগঠন নেতিয়ে পড়া, বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো প্রাচীন বা দশক দুই-এক আগের তৈরি সংগঠনগুলোর উদ্যোক্তা বা নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা নতুনদের জায়গা করে দেননি। নিজেরা পদ আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন। ফলে তরুণদের মধ্যে হতাশা কাজ করেছে।
তারা তাদের নতুন চিন্তা বিকাশের সুযোগ না পেয়ে সংগঠন বিমুখ হয়েছেন। ফলে যেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো গেলই। যে সংগঠনগুলো কোনোভাবে বেঁচে আছে, তাদের অবস্থাও প্রাচীন বৃক্ষের মতো। এখন আর নতুন পাতা বা অঙ্কুর দেখা যায় না। উপরে পড়ার ঝুঁকিতে আছে। কারণ এসব সংগঠনে যারা সভাপতি বা সম্পাদক আছেন, তারা আজীবন প্রায় বা দশকের পর দশক একই পদ আঁকড়ে আছেন।
কোনো কোনো সংগঠনের নিমন্ত্রণ পত্র পাই। দেখি একই পদে পরিচিত মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে আছেন। আতঙ্কিত হই, তাহলে কি ঐ দায়িত্ব পালন বা সেই পদে যাওয়ার মতো মানুষ তৈরি হচ্ছে না? যদি তাই হয়, তাহলে সমাজ বিপদে আছে।
ঘুরে ফিরে চেনা কিছু মুখ শুধু রদবদল হয় কোনো কোনটিতে। ফলে সংগঠনের যে স্বাভাবিক কার্যক্রম, চিন্তার মিথস্ক্রিয়া, সেই কাজটি হচ্ছে না। এই কারণে মফস্বল শহরগুলোয় সংস্কৃতির সেই মুখরতা বা সুর বিরল হয়ে উঠছে।
তৃণ থেকে কেন্দ্রে এই রোগ এসে পৌঁছেছে বলে খবর পাই। ব্যক্তিগতভাবে ঢাকার সংস্কৃতি চর্চার পর্যবেক্ষক বা দর্শক আমি। আনন্দ কুড়াতেও পাড়ায় যাওয়া হয়। তাও নিয়মিত যাওয়ার সময় পাই না। দূর থেকে শুনি, দেখি।
কোনো কোনো সংগঠনের নিমন্ত্রণ পত্র পাই। দেখি একই পদে পরিচিত মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে আছেন। আতঙ্কিত হই, তাহলে কি ঐ দায়িত্ব পালন বা সেই পদে যাওয়ার মতো মানুষ তৈরি হচ্ছে না? যদি তাই হয়, তাহলে সমাজ বিপদে আছে।
আরও পড়ুন >>> সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক
নতুন চিন্তাশীল বা শিল্প সাহিত্যে নেতৃত্ব দিয়ে যাবেন, এমন মানুষ উৎপাদন করতে না পারাতো সমাজ বা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু খবর নিয়ে দেখে বা একটু নিকট পর্যবেক্ষণেই বুঝে যাই—যোগ্যের অভাব নেই।
অভাব-নতুনকে জায়গা করে দেওয়ার সাহস। সমাজ সেই সাহস হারিয়ে বসে আছে। আমরা বলে যাচ্ছি যখন, সব অসুন্দরের বিরুদ্ধে আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই তীব্র করতে হবে। তখন এই সাহস হারানো, সমাজের জন্য দুঃসংবাদ।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী