ছবি : সংগৃহীত

ইংরেজি বানান ধরলে উচ্চারণটা হওয়ার কথা ‘ডেঙ্গি’, ডাক্তাররা এখনো তাই বলেন। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কীভাবে কীভাবে যেন এটি 'ডেঙ্গু' হিসেবেই কুখ্যাতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। তার মানে এর আগে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ছিল না, তেমনটি বলা সঙ্গত হবে না।

বলা ভালো, ২০০০ সালের আগে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি। তবে ডেঙ্গু কিন্তু হাজার বছরের পুরোনো অসুখ। আমাদের অজ্ঞানতাকে আমরা রহস্যের আবরণে ঢেকে রাখি। আমার বাবা যখন ক্লাস থ্রি'তে পড়েন, তখন তার বাবা, মানে আমার দাদা ক্বারী আব্দুর রহমান মারা গেছেন।

তারপর ছোট দুই ভাই আর মাকে নিয়ে আমার বাবাকে পাড়ি দিতে হয়েছে সংগ্রামমুখর এক লম্বা পথ। পরে দাদির কাছ থেকে শুনেছি, 'তিনদিনের জ্বরে তর দাদায় মইরা গেল।' সেই আমলে আমার দাদার মৃত্যুর কারণ যে 'তিনদিনের জ্বর' তা শনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না। সময়ের সাথে সাথে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে, শনাক্তকরণ পদ্ধতি আধুনিক হয়েছে। এই সময়েও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু আমাদের জন্য বেদনার, গ্লানির।

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?

শনাক্তকরণের হিসাব ধরলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু একবিংশ শতাব্দীর স্মার্ট সময়ের অসুখ। শনাক্তকরণের হিসাব ধরলে ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাও কিন্তু ২৩ বছরের। কীভাবে ডেঙ্গু হয়, ডেঙ্গু ঠেকানোর উপায়, ডেঙ্গুর চিকিৎসা পদ্ধতিও এতদিনে সবার জানা। তারপরও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান মৃত্যু আমাদের শঙ্কিত করে। ২০০০ সালে মানে শনাক্তকরণের প্রথম বছরে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। তারপর সবার সম্মিলিত চেষ্টা আর সচেতনতায় মৃত্যু নেমে এসেছিল শূন্যের কোঠায়।

২০১৮ সালে ডেঙ্গু মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে ফিরে আসে, সেই বছর মারা যান ২৬ জন। তবে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। সেই বছর লাখের ওপর আক্রান্ত হওয়া এবং ১৭৯ জনের মৃত্যু সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু এত ভাবনা-চিন্তা আর ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা অর্থহীন হয়ে যায়, যখন মৌসুমের শুরুতেই বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যা।

২০২০ সালে করোনা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাকি সবকিছু। কিন্তু অচেনা করোনাকে আমরা যতটা দক্ষতায় মোকাবিলা করলাম, ডেঙ্গুকে ততটা পারলাম না কেন? প্রশ্নটা হয়তো বোকার মতো, তবু এই কৌতূহল আমার যায় না।

২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১০৫ জন। তবে ডেঙ্গু তার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ২০২২ সালে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮১ জন। ২০২৩ সালে মৌসুমের শুরুতেই লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি, আমাদের শঙ্কিত করছে।

আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ 

ডেঙ্গু হলো বর্ষার রোগ। জুন থেকে সেপ্টেম্বর হলো ডেঙ্গুর মূল মৌসুম। এবার মৌসুম শুরুর আগেই মারা গেছেন ১৩ জন। আর জুনের ১৯ দিনে ২৩ জনের মৃত্যু এবার আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর দিনের চোখ রাঙাচ্ছে। পরিসংখ্যানের ওপর আমাদের ভরসা করতে হয়, কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করার সাহস পাই না। বাংলাদেশের কোনো অজপাড়াগায়ে আমার দাদার মতো কে 'তিনদিনের জ্বরে' মরে যায়; সব খবর কি আমরা পাই?

কীভাবে ডেঙ্গু হয়, ডেঙ্গু ঠেকানোর উপায়, ডেঙ্গুর চিকিৎসা পদ্ধতিও এতদিনে সবার জানা। তারপরও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান মৃত্যু আমাদের শঙ্কিত করে।

ডেঙ্গু হয় স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে। আর এডিস মশা কামড়ায় দিনের বেলায়। গবেষকরা বলছেন, এখন রাতেও এডিস মশা কামড় দেয়। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে। বৃষ্টি হলেই পানি জমে। আর দুই দিনের জমে থাকা পানি এডিসের বংশবৃদ্ধির মোক্ষম ক্ষেত্র।

ডেঙ্গু তাই বর্ষার রোগ। জুন থেকে সেপ্টেম্বর হলো এডিস মশার প্রজননকাল। তবে এবার বর্ষার আগেই বিচ্ছিন্ন বৃষ্টি কিছুটা আগেই ডেঙ্গু নিয়ে এসেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মে মাসেই আশঙ্কা করেছিল, সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এই বছর ডেঙ্গুর বিস্তার হবে ভয়াবহ।

সময়মতো ব্যবস্থা আমরা নেইনি। এখন আমরা ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের ভয়ে কাঁপছি। এতদিন ডেঙ্গু ছিল শহুরে অসুখ। মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু এবার লক্ষণ যা দেখা যাচ্ছে, তাতে ঢাকার বাইরের মফস্বল শহরগুলোয়ও ডেঙ্গু বিস্তারের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২৩ বছরের অভিজ্ঞতায় ডেঙ্গু সম্পর্কে সব মানুষই কম বেশি জানেন। ডেঙ্গুর চিকিৎসাটাও জটিল বা ব্যয়বহুল নয়। খালি সময়মতো রোগটা শনাক্ত হতে হবে এবং সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তাই এখন জ্বর হলে একদম খামখেয়ালি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর টেস্ট করতে হবে।

ডেঙ্গুর টেস্টও ব্যয়বহুল নয়। সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকাতেই ডেঙ্গুর টেস্ট করা যায়। আর ডেঙ্গু হলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হবে এমনও নয়। এখন ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রটোকল বাংলাদেশের সব চিকিৎসকেরই মুখস্থ। পরিমাপমতো স্যালাইন দিলেই অনেক সময় সুস্থ হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু : এত ভয়াবহ আকার ধারণ করল কেন? 

তবে সময়মতো সেই পরিমাপটা ঠিক করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্লাটিলেট বেশি কমে গেলে রক্ত দিতে হতে পারে। তবে সতর্ক থাকলে এবং শুরুতেই শনাক্ত হয়ে গেলে অল্পতেই সুস্থ হওয়া সম্ভব।

সবাই সবকিছু জানার পরও মৌসুমের শুরুতেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু আমাদের শঙ্কিত করেছে। এত সতর্কতার পরও মৃত্যু বেদনাদায়ক। সবাই মিলে চেষ্টা করলে তা রোধ করা সম্ভব। ডেঙ্গুতে মৃত্যু শূন্যতে নামিয়ে আনার উপায় একটাই, মশা থেকে দূরে থাকা।

আপনার এলাকায় যদি মশার উৎপাত থাকে, দিনরাত মশারি টানিয়ে রাখুন। বিশেষ করে শিশুদের মশারির ভেতরে রাখুন। যথাসম্ভব হাত-পা ঢেকে রাখুন, যাতে মশা আপনার নাগাল না পায়। এখন নানারকম লিকুইড পাওয়া যায়, যা মাখলে মশা আপনার কাছে আসতে পারবে না। কিন্তু নন্দলালের মতো দুর্ঘটনার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে তো ডেঙ্গু না হলেও না খেয়ে মরতে হবে।

মশার ভয়ে তো আমরা অফিস-আদালত, চাকরি-বাকরি, স্কুল-কলেজ ফেলে সারাদিন তো আর মশারির ভেতরে বসে থাকতে পারবো না। তাই মশা থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো মশার বংশবিস্তার ঠেকিয়ে রাখা, আর বংশবিস্তার ঠেকাতে না পারলে মেরে ফেলা।

...কখনো ওষুধ ফুরিয়ে যায়, কখনো ওষুধ কাজ করে না। মশা মারতে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ লাগে। এবার ডেঙ্গু কিছুটা আগে এসেছে বলে, আলোচনাটাও শুরু হয়েছিল আগেভাগেই। কিন্তু আলোচনাই সার। কাজের কাজ কিছু যে হয়নি, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

সবসময় আমরা বলি ভুল বা বিপদ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, আমরা আসলে কোনো শিক্ষাই নেই না। অনেকবছর ধরে ডেঙ্গুর কারণে মশা মারার বিষয়টা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু কখনোই ‘মশক নিধন অভিযান’ পুরোপুরি সফল হয় না।

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব? 

কখনো ওষুধ ফুরিয়ে যায়, কখনো ওষুধ কাজ করে না। মশা মারতে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ লাগে। এবার ডেঙ্গু কিছুটা আগে এসেছে বলে, আলোচনাটাও শুরু হয়েছিল আগেভাগেই। কিন্তু আলোচনাই সার। কাজের কাজ কিছু যে হয়নি, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মানুষের বাঁচতে হলে, এডিসকে মরতে হবে। এটা সহজ সমীকরণ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই সহজ সমীকরণটা জটিল করা যাবে না।

মশা মারার মূল কাজ মেয়রের মানে সিটি কর্পোরেশনের। তবে সব দায়িত্ব মেয়রদের হাতে দিয়ে, তাদের ব্যর্থ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে নিজেদের কাজটুকু করে রাখা ভালো। এডিস মশা ঠেকানোর কৌশল আমাদের সবার জানা। কোথাও ময়লা রাখা যাবে না, পানি জমতে পারে, এমন কোনো ব্যবস্থা যেন না থাকে।

এখন থেকেই যদি আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখি; পরিত্যক্ত ডাবের খোসা, টায়ার, নজরের বাইরে থাকা ফুলের টব, নির্মাণকাজের খানাখন্দ যেন এখন দূর করে রাখি। ছাদ বাগানের দিকে যেন সতর্ক দৃষ্টি রাখি। যাতে বৃষ্টি হলেও যাতে পানি জমতে না পারে। এমনকি আপনার বাসার কমোডে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতেও এডিসের বংশবৃদ্ধি ঘটতে পারে। সোজা হিসাব—স্বচ্ছ পানি জমতে না পারলে এডিস বংশবিস্তার করতে পারবে না।

তবে সিটি কর্পোরেশন একা যেমন পারবে না আবার ব্যক্তি সচেতনতায়ও পুরোপুরি নিরাপদ থাকা যাবে না। সচেতনতার একটা সম্মিলিত প্রয়াস লাগবে। কারণ আপনি আপনার বাসা নিরাপদ রাখলেন কিন্তু পাশের বাসায় যদি এডিসের কারখানা থাকে, আপনি কিন্তু বাঁচতে পারবেন না। তাই পরিচ্ছন্নতা অভিযানটা হতে হবে সর্বাত্মক।

আরও পড়ুন >>> এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ : করণীয় কী?

ডেঙ্গুর মৌসুম মাত্র শুরু হয়েছে। ভরা বর্ষা এখনো আসেনি। এখনই সবাই মিলে যদি এডিসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই শুরু করি, তাহলে আমরা বছরের বাকি সময়টায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখতে পারবো।

সবচেয়ে ভালো হয়, আর একজনকেও ডেঙ্গুতে মরতে না দিলে। কারণ একেকটি মৃত্যু আমাদের কাছে একটি সংখ্যা, একটি পরিসংখ্যানমাত্র। কিন্তু যার যায়, সে বোঝে। একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এডিসের মতো চেনা শত্রু, ডেঙ্গুর মতো চেনা জ্বরে প্রতিটি মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়।